কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই
Dainik Business File: নভেম্বর ১৫, ২০২০
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে হার মানলেন সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা। মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা যুগ যেন শেষ হয়ে গেলো। বাঙালি অনুরাগীকূলের প্রার্থনা আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরাতে পারল না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে।
রোববার (১৫ নভেম্বর) দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট নাগাদ হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। প্রবীণ অভিনেতার প্রয়াণের খবর প্রকাশ্যে আসতেই শোকের ছায়া বিনোদন জগতে।
হাসপাতালের পক্ষ থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর বিষয়টি অফিশিয়ালি ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এ অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
শনিবার অর্থাৎ দীপাবলির দিনই চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, চিকিৎসায় আর সাড়া দিচ্ছেন না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর শরীরের একাধিক অঙ্গ-প্রতঙ্গই আর কাজ করেছে না। মাল্টি অর্গান ফেলিওরের পরই সম্পূর্ণ লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল বর্ষীয়ান অভিনেতাকে। পূর্ণ মাত্রায় অক্সিজেন দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা একেবারে কমে গিয়েছিল।
নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি হন সৌমিত্র। তিনি একটা সময়ে ক্যানসারেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই অসুস্থতা স্বভাবতই তাঁকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। ফলে কখনও উন্নতি কখনও অবনতি, এই দোলাচলেই পার হচ্ছিল হাসপাতাল-বন্দি সৌমিত্রর সময়।
এছাড়াও একাধিক কো-মর্বিডিটি ছিল তাঁর। ফলে সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে তাঁর। তবুও প্লাজমা থেরাপি, শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচারসহ নানা ভাবে অভিনেতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে আসছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু, ব্যর্থ হলো সব চেষ্টা। ৪০ দিনের দীর্ঘ শারীরিক লড়াইয়ের পর হার মানলেন সৌমিত্র।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনিত সেরা ও আলোচিত ১০টি সিনেমার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো নিচে-
১. ক্লাসিক অপু : ক্লাসিক অপুর সংসার সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন কিংবদন্তী সৌমিত্র। সিনেমাটি প্রকাশ হওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’; শর্মিলা ঠাকুরের সাথে তার এ সংলাপ ও রসায়ন এখনও বাঙালির মনে ঢেউ তোলে। পরে নারী মহলে ঢেউ তোলা এ সুদর্শন পুরুষকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২-৩. সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ (ফেলুদা চরিত্র) : ভারতের উপমহাদেশের জনপ্রিয় চরিত্র ফেলুদা। সত্যজিৎ রায় রচিত এ চরিত্রের অবলম্বনে নির্মাণ করা হয় সিনেমা। এখানে চরিত্রটিকে বড় পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন ওই গুণী সৌমিত্র। ১৯৭৪ সালে সোনার কেল্লা এবং ১৯৭৮ সালে জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন টলি সিনেমার এ বৃহৎ নায়ক।
৪. দেবী : ১৯৬০ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এ ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এ সিনেমা সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার রাষ্ট্রপতি রৌপ্য পদক লাভ করে ১৯৬০ সালে। এছাড়াও ১৯৬২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পালমে ডি’অর এ মনোনীত হয়েছিল সেই সময়।
৫. হীরক রাজার দেশে: এটি ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। রুপকের আশ্রয় নিয়ে চলচ্চিত্রটিতে কিছু ধ্রুব সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি গুপী গাইন বাঘা বাইন সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের সকল সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে। তবে কেবল একটি চরিত্র ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি। তিনি হলেন শিক্ষক। এ দ্বারা বোঝানো হয়েছে একমাত্র শিক্ষক মুক্ত চিন্তার অধিকারী, বাদবাকি সবার চিন্তাই নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ।
৬. চারুলতা : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় গল্প ‘নষ্টনীড়’ এর কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে এর চিত্রনাট্য। ‘নষ্টনীড়’ গল্পে দেখানো হয়েছে নব্বই দশকের (১৮৭৯) ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এ সিনেমার সার্থকতা বয়ে আনার জন্য গল্পের কাহিনীতে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া এ সিনেমা ইংরেজিভাষী বিশ্বে সবার কাছে ‘দ্য লনলি ওয়াইফ’ নামে পরিচিত।
৭. বাক্স বদল : ১৯৬৫ সালের নিত্যানন্দ দত্ত পরিচালিত ‘বাক্স বদল’ চলচ্চিত্রটি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীতায়োজনে প্রকাশ করেছিল ডিএম প্রডাকশন্স হাউজ। এতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অভিনয় করেছেন অপর্ণা সেন, প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, সুব্রত সেন, এবং সাবিত্রি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। সিনেমাটি সম্পূর্ণ কমেডি ধাঁচের।
৮. কাপুরুষ : ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাপুরুষ’ সিনেমার মূল নাম ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’। দুটি পৃথক গল্পকে একত্র করে নির্মিত এ সিনেমা। প্রথম গল্পের নাম কাপুরুষ; এর মূল গল্পকার সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের জনৈক কাপুরুষের গল্প থেকে নেয়া।
৯. বেলা শেষে : ২০১৫ সালের মে মাসের ১ তারিখে কলকাতায় মুক্তি পায় এ ভারতীয় চলচ্চিত্রটি। এতে সাহিত্যপ্রেমী সৌমিত্র দুর্গা উৎসব উপলক্ষে ছেলে, ছেলের বউ, তিন মেয়ে এবং মেয়ের জামাইদের একত্র করেন। সকলের চিন্তা ভাবনা- বাবা বোধয় তার সম্পত্তির উইল পড়ে শোনাবেন তাদের; কিন্তু না। উপস্থিত সবাইকে অবাক হওয়ার মতো বার্তা শোনান সৌমিত্র। দীর্ঘ ৪৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি চান তিনি। স্ত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তার সাথে আর একত্রে থাকবেন না। বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছেন। তাই আদালতের দ্বারস্থ হলে তাদের ১৫ দিন একসঙ্গে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা আবার সেই আগের মতো শুরু করেন জীবন-যাপন।
১০. প্রাক্তন : ২০১৬ সালের ২০ মে মাসে সিনেমাটি কলকাতা ও সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে একযোগে ৯০টি সিনেমা হলে মুক্তি পায়। কলকাতার বাইরেও সিনেমাটি ভারতের অন্যান্য ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ শহর, যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি এবং কানাডার একটি শহরে মুক্তি পায়। টলি সিনেমার ইতিহাসে এটাই বিশাল মুক্তির ছবি। এ সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আরও অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা, অপারিজাতা আঢ্য, বিশ্বনাথ বসু, মানালি দে, সাবিত্রি চট্টোপাধ্যয়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যয় প্রমুখ।
টলি সিনেমার এ মহাপুরুষ অভিষেকের পরই যেন কেড়ে নেন লাইমলাইট। তিনি একে একে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘স্বরলিপি’, ‘সমাপ্তি তিনকন্যা’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘আগুন’, ‘বেনারসি’, ‘অভিযান’, ‘শেষ প্রহর’, ‘কাচ কাটা হীরে’, ‘অশনি সংকেত’ ও ‘সাতপাকে বাঁধা’ সহ উল্লেখযোগ্য ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের অবস্থান শক্ত করে তুলেন। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে তার অনবদ্য অভিনয়ের মধ্যে রয়েছে অংশুমানের ছবি (২০০৯), হেমলক সোসাইটি (২০১২), শেষ চিঠি (২০১৭), বসু পরিবহন (২০১৮) এবং অবাক কাণ্ড (২০১৮) সিনেমাসমূহ।
সম্পাদক- অভি চৌধুরী।
যোগাযোগ: ৫১/৫১/এ রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (লেভেল-৩), স্যুট-৪০৫, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
ফোন:০২-২২৩৩৫৭০৭৩ মোবাইল: ০১৭১১-৫২০০৪৬, ০১৮১৯-২২৬১৬০। ই-মেইল: dainikbusinessfile@gmail.com