সরকারি গুরুত্বের অভাবে বিলুপ্তির পথে কিশোরগঞ্জের পান আবাদ

Dainik Business File: জানুয়ারি ২২, ২০২৫

সরকারি গুরুত্বের অভাবে বিলুপ্তির পথে কিশোরগঞ্জের পান আবাদ আলি জামশেদ, হাওর অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুরসহ ও অন্যান্য উজান এলাকাগুলো থেকে বিভিন্ন ধরণের পানের আবাদ। স্থানীয় পান চাষীদের ভাষ্য আবহাওয়ার তারতম্যের পাশাপাশি খরচের দিক বিবেচনা করে বর্তমানে অত্র এলাকায় পানের আবাদ করে পোষায়নি বলেও উল্লেখ করেন। সরকারিভাবেও দেয়া হয় না কোন ধরণের প্রণোদনা। যে কারণে অত্র এলাকা থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে পানের আবাদ। সরেজমিনেও এমনি তথ্য মিল। জেলা কৃষি অফিস সূত্রও এমন তথ্য নিশ্চিত করেন। অনুসন্ধানে দেখা দেখা রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহর ও নগরের পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় যে সকল পান আসে তাদের অধিকাংশই রাজশাহী, মহেশখালী, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ঝিনাইদহের বলে জানা গেছে। এছাড়াও অন্যান্য অঞ্চলে তুলনামূলক অনেক কম। এ সব অঞ্চলের পান বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান বলে জানা গেছে। নিকলী উপজেলা সদরের পান ব্যবসায়ী দ্বিলীপ পালের তথ্যমতে সপ্তাহের ৪ দিন ঝিনাইদহ থেকে রোদার পুড্ডা বাজারে ৬-৭ লাখের অধিক টাকার পান ফরজ আলী, হযরত আলী, লিটন সাহাসহ তারা সকলে মিলে নিয়মিত আমদানি করে থাকেন। এতে তারা মাত্র শতকরা ১০ ভাগ কমিশন পান বলে জানান। বিশ্বাসের উপর এ ব্যবসা হয়ে থাকে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে এলাকায় পানের বরজ থাকাকালীন সময়ে তাদের লাভ বেশি হতো বলেও উল্লেখ করেন। মাঝারি সাইজের কুড়ি বিড়া পান ১হাজার টাকা বিক্রি করেন বলে জানান। তবে সাইজ অনুযায়ী দাম হয়ে থাকে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। নিকলীর আঠার বাড়িয়ার গুপিরায় বাজারের খুচরা পান বিক্রেতা বাচ্চু মিয়া বলেন, সারা বছর পান বিক্রি করলেও তুলনামূলক শীতকালে বেশি বিক্রি করে থাকেন। তবে এলাকার পানের চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাইকারের কাছে থেকে চালানি পান কিনার কারণে লাভের পরিমাণটা কমে গেছে। সরেজমিনে কামালপুর এলাকার বরজ মালিক স্বদেশ চন্দ্র ভদ্রের সাথে সরেজমিনে কথা হলে অভিযোগের সুরে তিনি বলেন, পান চাষে এখন আর পোষায়নি। তুলনামূলক বেশ উচু জমি লাগে, উর্বর মাটি ভরাট করতে হয়। এতে খাটুনি অনেক বেশি। কঞ্চি ও বাঁশের দামসহ শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে এখন পোষায়নি। আগে বেশ কয়েকটি বরজ ছিল এখন শুধু মাত্র একটা আছে বলে উল্লেখ করেন। আবহাওয়া জনিত সমস্যা এখন পান চাষে বাধা বলে জানান। অতিরিক্ত গরমেও পানে পচন ধরে আর অতিরিক্ত শীতেও পানের ক্ষতি হয়। পানকে অর্থকরী ফসল হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। পান একটি সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ পাতা। সব খাবারের শেষে এটিকে মিষ্টি জাতীয় খাবারের ন্যায় ব্যাবহার করা হয় বলে জেলা কৃষি কর্মকর্তার অভিমত। এটি একপ্রকার লতাজাতীয় গাছের পাতা। পান পাতার সাথে সুপাড়ি,তরল চুন ও তামাক পাতাসহ বেশ কিছু মুখরোচক উপকরণ ও মেডিসিনের সংমিশ্রণে পান তৈরি করে থাকে। ভারতবর্ষসহ এশিয়া মহাদেশেই বিভিন্ন ধরণের উপাদানের সংমিশ্রণে পান খাওয়ার প্রচলন তুলনামূলক বেশি বলে একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে। পানের বোটানিক্যাল নাম Piper betle Linn আর্য এবং আরবগণ পানকে তাম্বুল নামেও অভিহিত করতো। নিশ্বাসকে সুরভিত করা এবং ঠোঁট ও জিহবাকে লাল করার জন্যেও অনেকে পান খেয়ে থাকে। অনেকে পান পাতাকে নেশা জাতীয় আইটেমে পরিণত করে নেয়। বৈজ্ঞানিকভাবে পানের উপকারিতা এবং অপকারিতা দুটোই রয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশে সাঁচিসহ মিঠা পান, গোলাব পান, জর্দা পান,কহিনুর পান, বেনারসি পানসহ বেশ কয়েক জাতের পান রয়েছে। আবহাওয়া ও জাতভেদে পানের আকার ও বর্ণের পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে ফলনেও তারতম্য দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। গবেষকদের তথ্যমতে পান পাতায় রয়েছে অ্যান্টি-হাইপারগ্লাইসেমিক যৌগ যা মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সহায়তা করে। খাওয়ার পর মুখশুদ্ধি হিসেবে পান খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে অনেকেরই। আয়ুর্বেদ তথ্যমতে, পানের ভেষজের বহুগুন রয়েছে। শুধু খাবার হজমে নয়, পান পাতা ডায়াবিটিসজনীত বাতের ব্যথাসহ অনেক ধরণের ব্যাথাও নিয়ন্ত্রণ করে বলে উল্লেখ রয়েছে। পান পাতায় রয়েছে এক ধরণের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল যৌগ, যা মুখের দুর্গন্ধও দূর করে। পান পাতায় রয়েছে গ্যাস্ট্রো প্রটেকটিভ, অ্যান্টি-ফ্লটুলেন্ট এবং কার্মিনেটিভ এজেন্ট যার কারণে পান চাবানোর সময় মুখে স্যালাইভা তৈরি করে। যা খাবার হজম করতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামান্য পরিমাণ পানের পাতা প্রতিদিন চিবোতে পারলে দাঁত এবং মাড়ির স্বাস্থ্য ভাল থাকে। পান পাতার অ্যান্টিসেপটিক গুণ দাঁতে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ রোধ করে। শুধু তাই নয় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতেও পান পাতা ছেঁচে সেই রস খেলেও উপকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। পানের উপকারিতার পিছনে ক্ষতিকর প্রভাবও কাজ করে মূলত তামাকজাত দ্রব্যের মিশ্রণে পান চিবানোতে মাড়ির ক্ষতি, দাঁতের ক্ষয়জনিত ক্ষতি হয়। মুখে এক ধরনের ক্যান্সার ও দুর্গন্ধ হয়। ক্যান্সার সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা (আইএআরসি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন (ডাব্লুএইচও) বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করে, পান কুইড ও সুপারি বাদাম চিবানো মূলত ক্যান্সারজনক উপাদানের অন্যতম। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আরকা বাদামের সাথে তামাকসহ পানে ৯.৯ এবং ৮.৪ গুণ মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তাইওয়ানে একটি গবেষণায়, বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন সুপারি কুইড (পান) চিবানোর কারণে মুখের ক্যান্সার ছাড়িয়ে পরার ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে তামাকের অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও। মুখের ক্যান্সার ছারাও খাদ্যনালী, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, স্বরযন্ত্র, ফুসফুস এবং সমস্ত শরীরে পান পানসেবীদের মধ্যে ক্যান্সার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা বেশিরভাগ সুপারি চিবায় এবং ধূমপান সিনারজিস্টিক্যালি মিথস্ক্রিয়া করে তাদের অর্ধেকেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকে। পান পাতা চিবানো মানুষের জীবনকাল প্রায় ছয় বছর কমিয়ে যাচ্ছে বলেও বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। একটি ল্যানসেট অনকোলজি প্রকাশনায় দাবি করা হয়েছে যে, পান মসলার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে টিউমার হতে পারে। এটি কেবল মুখ গহ্বরের সীমাবদ্ধ থাকে না পর্যায়ক্রমে সমস্ত শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে। গর্ভাবস্থায় পান চিবানো সম্পর্কে তাইওয়ান, মালয়েশিয়া এবং পাপুয়া নিউ গিনির বৈজ্ঞানিক দলগুলি কয়েক দফায় জানিয়েছেন যে, গর্ভাবস্থায় যে মহিলারা পান চিবায়, তাদের গর্ভকালীন শিশুর উপরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এ প্রভাবগুলো গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল বা তামাক সেবনকারী মহিলাদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বলে জানা গেছে। এতে করে ওজন কম এবং বামন আকৃতির শিশুর জন্ম দেয় বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। বাজিতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, পান চাষে যারা আগ্রহ দেখাবে তাদের প্রতি উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। জেলা কৃষি কর্মকতা আবুল কালাম আজাদ কিশোরগঞ্জের পান চাষীদের আগ্রহটা দিন দিন কমে যাওয়ার কথার সাথে স্পষ্টভাবে সহমত পোষণ করেছেন। তিনি যুক্তি তুলেছেন পান অর্থকরী ফসল হলেও কিশোরগঞ্জের তিন ফসলি জমিতে পানের আবাদের তুলনায় বিভিন্ন ধরণের ফসলে চাষীদের লাভ তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। চাষীরা সাধারণত যে ফসলে লাভবান হয় সেদিকেই অধিক পরিমাণে ঝুঁকে। তাছাড়া সরকারিভাবে পান চাষে কোন প্রকার প্রণোদনার ব্যবস্থাও নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সম্পাদক- অভি চৌধুরী।

যোগাযোগ: ৫১/৫১/এ রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (লেভেল-৩), স্যুট-৪০৫, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
ফোন:০২-২২৩৩৫৭০৭৩ মোবাইল: ০১৭১১-৫২০০৪৬, ০১৮১৯-২২৬১৬০। ই-মেইল: dainikbusinessfile@gmail.com