আইফেল টাওয়ারে আলো দেয়া তাপস সেন আজো অন্ধকারে
Dainik Business File: অক্টোবর ১৫, ২০২০
প্যারিসের মূল আকর্ষণ হরো আইফেল টাওয়ার। প্যারিস গিয়ে ঐতিহাসিক এই টাওয়ারে ঘুরতে যায় না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দিনের বেলায়ে আইফেল টাওয়ারের রূপ যেমন ঝলসে পড়ে ঠিক রাতেও চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
বিশেষ করে রাতের প্যারিসের চোখ ধাঁধানো আইফেল টাওয়ারের রূপে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় সবার। লাল বাতি নীল বাতির আলোয় মোড়া আইফেল হলো পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম এক আশ্চর্য।
কথায় বলে প্রেমের শহর প্যারিস। আলোর ধারায় ঝলমলিয়ে ওঠা আইফেল বহু মানুষের কাছে স্বপ্ন। রাতের অন্ধকার ম্লান হয়ে যায় আইফেল টাওয়ারের জৌলুসের কাছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা ক্যামেরাবন্দি করেন সেই দৃশ্য। তবে আকাশ ছোঁয়া এই লোহার টাওয়ারকে রঙিন আলোর জাদুতে যিনি সাজিয়ে তুলেছিলেন সেই নেপথ্যের শিল্পীরা আজীবন অন্ধকারেই থেকে যান। কেউ মনে রাখেননি তাদের। বিদেশ তো বটেই এমনকি তার নিজের দেশ তথা শহরও মনে রাখেনি এদের।
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হলো প্যারিসের গর্ব, আইফেল টাওয়ার। যাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোতে মুড়ে দিয়েছিলেন এক বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ব্রিজকেও তিনিই সাজিয়েছিলেন আলোর মালায়।
হাওড়া ব্রিজের সেই আলো আজ আর নেই। শিল্পীও নিভে গিয়েছেন। শিল্পীর প্রিয় শহরও মনে রাখেনি তাকে। তিনিই হলেন আলোর যাদুকর তাপস সেন।
এই বরেণ্য ব্যক্তির সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত আলোশিল্পী রিচার্ড পিলব্রো তার লেখার মাধ্যমে বলেছিলেন যে, সামান্য কিছু উপকরণ, কয়েকটি ল্যাম্প, আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিস আর ছায়া-এই দিয়েই তিনি আলোর জাদু দেখাতেন।
এছাড়াও কাচের গ্লোব, বাঁশপাতা, ছেঁড়া কাপড়, হ্যারিকেন এমন সব তুচ্ছ উপকরণ দিয়ে তিনি মায়া সৃষ্টি করতেন তার নাটকের মঞ্চে। আলো আঁধারীর খেলায় ডুবিয়ে রাখতেন দর্শককে। আলো আর অন্ধকারের যাদুতে তিনি চিরকাল আলোর তপস্যী। মেধা মননে জাত শিল্পী ছিলেন একজন।
১৯২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর অসমের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়িতে জন্ম খ্যাতনামা এই শিল্পীর। ঠাকুরদার বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। কিন্তু বাবা থাকতেন অসমে। পিতার নাম মতিলাল সেন মায়ের নাম সুবর্ণলতা সেন।
তাপস সেনের বয়স যখন এক বছর তখন বাবার চাকরির সূত্রে তাদেরকে দিল্লি চলে যেতে হয়। তখন থেকেই শুরু প্রবাসী জীবন। বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবটাই সেখানে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ছিলেন কিন্তু প্রবল টান অনুভব করতেন ছবি আঁকা, নাটক আর আলোর প্রতি। হাতে খড়ি হয়েছিল স্কুল জীবনে। ড্রইং শিক্ষক প্রতাপ সেনের উৎসাহে। তার উৎসাহেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে রাজপথ নাটকে প্রথম আলোর দায়িত্ব পান।
তখন স্কুল জীবন প্রায় শেষের দিকে। নাটকে রাস্তার দৃশ্যে ল্যাম্পপোস্টের আলো তৈরি করেছিলেন। সেই দিনই যেন নির্ধারিত হয়ে গেল তার বাকি জীবনের নিয়তি। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাপস সেনকে।
প্রথমে নয়াদিল্লির মিউনিসিপল কর্পোরেশনে, তারপর আরউইন হাসপাতালে, শেষে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে সিপিডব্লিউডির ইলেকট্রিক বিভাগে চাকরি শুরু করেছিলেন তিনি। মাইনে সে সেময়ের নিরিখে নেহাত খারাপ ছিল না।
তবে চার-দেয়ালে বন্দি হয়ে কাগজ-কলমে ৮টা ৫টার চাকরিতে দমবন্ধ হয়ে আসত তার। টানাপোড়েন আর বেশি দিন চলল না। চাকরি ছেড়ে পাড়ি দিলেন তখনকার বম্বে অর্থাৎ মুম্বাইতে।
ক্যামেরা ও আলোর কাজ শেখার জন্য। এরপর তিনি বিখ্যাত ফটোগ্রাফার দিলীপ গুপ্তের কাছে ফটোগ্রাফির কাজ শুরু করেন। মুম্বাইতে কিছুদিন কাজ করার পরে ১৯৪৭ সালে কলকাতায় চলে আসেন তিনি।
দিল্লিতে থাকাকালীন গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই টানেই কলকাতায় এসেও বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন তাপস সেন। এদিকে আর্থিক সংকটও চরমে। বছর দুয়েক এভাবে চলার পর চাকরি পেলেন নিউ থিয়েটার্সে।
নিউ থিয়েটার্সের আর্থিক অবস্থা তখন বিশেষ ভালো নয়। তার মধ্যেই জীবনে প্রথমবার সিনেমায় কাজের সুযোগ মিলে তার। সৌরিন সেনের ছবি ‘রূপকথায়’। তিনি সহকারি পরিচালক। সৌরিন সেন সে সময়ের নাম করা আর্ট ডিরেক্টর।
ছবির কাজে যুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারেননি। নিউ থিয়েটার্সে আরও এক মোড় ঘোরানো ঘটনা ঘটেছিল তার সঙ্গে। বন্ধুত্ব হয়েছিল হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তার সূত্রেই আলাপ মৃণাল ঋত্বিক-বিজন-সলিলদের সঙ্গে।
কলকাতায় থিয়েটারের মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ প্রযোজনা দিয়ে। প্রথম অভিনয় লেক টেম্পল রোডের কালচার ক্লাবে। পাঁচের দশকের গোড়া থেকে কলকাতার বহু সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন।
সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটার। সব জায়গাতেই তিনি আলোর শিল্পী। ধীরে ধীরে তার ‘সিগনেচার’ স্টাইলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠল শহর। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তের সঙ্গে কাজ করেছেন।
কল্লোল, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, সেতু, তিতাস একটি নদীর নাম, রক্তকরবী- এমন সব অসামান্য প্রযোজনা। সংলাপ, মঞ্চ, অভিনয় যেন দৃশ্যে-দৃশ্যে খুন করত দর্শকদের।
তাপস সেন মনে করতেন, ছায়া বা আঁধার না থাকলে আলোর মর্ম পরিস্ফুট হয় না। আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন। নিজেকে বলতেনও ‘আড়ালের মানুষ’। তবু তার আলোর কাছে নত হতে হয়েছিল সারা পৃথিবীকে।
৯৭২ সালে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘লাইট ডিজাইনার’ এর স্বীকৃতি পান। তবু তিনি নেপথ্যেই। ১৯ ৮৫ সালে প্যারিসে ভারত উৎসবে তো খোদ আইফেল টাওয়ারই ঝলসে উঠল তাপসের আলোয়! পরে মস্কো, লেনিনগ্রাদ, তাসখন্দেও তা-ই।
এরপর ২০০৬ সালের ২৮ জুন তাপস সেন কলকাতায় নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন। মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি। তার সেই নশ্বর দেহ চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহারে জন্য দান করা হয় পরিবারের তরফে।
সম্পাদক- অভি চৌধুরী।
যোগাযোগ: ৫১/৫১/এ রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (লেভেল-৩), স্যুট-৪০৫, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
ফোন:০২-২২৩৩৫৭০৭৩ মোবাইল: ০১৭১১-৫২০০৪৬, ০১৮১৯-২২৬১৬০। ই-মেইল: dainikbusinessfile@gmail.com