লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েসের বিরুদ্ধে ইউএনওসহ ১৮জন অফিসারের লিখিত অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সোমবার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় এ তথ্য নিশ্চিত করেন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর। এর আগে বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) রাতে গণস্বাক্ষরিত অভিযোগটি জেলা প্রশাসক বরাবরে দায়ের করেন ইউএনওসহ ১৮ জন অফিসার।
জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, আদিতমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উপজেলার কর্মকর্তাদের লিখিত অভিযোগটি দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব (ডিডিএলজি) রফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দুই কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে সোমবার (১৬ নভেম্বর) বিকেলে ৩৭ পাতার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিসহ অনেকের লিখিত বক্তব্যের কপি সংযোজন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি সোমবার বিকেলেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে।
ইউএনওকে হত্যার হুমকী ও অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দের সত্যতা মিলেছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, অনেক কিছু বিষয় তদন্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠানোর কারণে বলা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় তদন্ত প্রতিবেদন দেখে পরবর্তী যা নির্দেশনা দিবেন। সেভাবে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ দিকে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে সরকারি কাজে অফিসের বাইরে ছিলেন ইউএনও। এ সময় পরিচিত ও অপরিচিত কয়েকজন তার পিছনে মোটরসাইকেল নিয়ে অযথা ঘুরাফেরা করেন বলে জানান আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন। তবে নিরাপত্তা পর্যাপ্ত রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) ইউএনওসহ ১৮জন অফিসারের দায়ের করা অভিযোগে প্রকাশ, আদিতমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েস নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিধিবিধান ও নীতিমালা লংঘন করে কাজের জন্য চাপ প্রয়োগ করে আসছেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে সেই দফতরের কর্মকর্তাকে অশ্রব্য ভাষায় গালমন্দসহ প্রাণনাশের হুমকিও দেন চেয়ারম্যান।
উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, ভিজিডি, মাতৃত্ব ভাতা, কৃষি প্রণোদনা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধাভোগীর তালিকায় নিজের অংশ দাবি করেন চেয়ারম্যান। বিধি বহির্ভূতভাবে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ না দেওয়ায় এবং প্রাক্কালন কাজ শেষ না হতেই বিল পরিশোধ না করায় সাম্প্রতিক সময় উপজেলা প্রকৌশলী ও সহকারী প্রকৌশলীকে রুমে বেঁধে পেটানোর হুমকি দেন চেয়ারম্যান।
শুধু তাই নয়, তার কথামত কাজ না করায় একজন নারী কর্মকর্তাকে বহিরাগতদের দিয়ে মানহানির ঘটনা ঘটানোর হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। সব দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা তুলে ধরা হয় অভিযোগে।
অভিযোগে আরো বলা হয়, বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) মাসিক সমন্বয় সভায় ভিজিডি ও মাতৃত্ব ভাতার তালিকায় নিজের অংশ দাবি করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। যা বিধি সম্মত না হওয়ায় ইউএনও নাকচ করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সভা শেষ না করে চলে যান চেয়ারম্যান। এরপর চেয়ারম্যান ইউএনও অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরা লোক দিয়ে খুলতে গেলে তার ছবি তোলেন ইউএনও মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন। একইসঙ্গে ক্যামেরা খুলে ফেলার কারণ জানতে চাইলে ইউএনওকে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করা হয় ‘(বেশি কথা বললে পিটিয়ে নরসিংদী পাঠিয়ে দেবো। উপজেলা পরিষদ কি তোর বাবার সম্পত্তি, উপজেলা পরিষদ কি তুই চালাবি?)’। এভাবে গালমন্দ করা হয় বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
চরম উত্তেজিত হয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোবাইলে কল করে তার দলের লোকদের ডাকলে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে থানা পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। ঘটনার পর থেকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনায় ওই দিন রাতে ইউএনওসহ ১৮জন অফিসার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবরে গণস্বাক্ষরিত একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। যার স্মারক নং – ০৫.৪৭.৫২০২.০০০.০২.০৮৩.২০- ৭৬৪। যার অনুলিপি বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়।
নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে রোববার (১৫ নভেম্বর) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদিতমারী থানায় জিডি (নাম্বার ৫৫৮) করেন ইউএনও মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন। একই দিন যৌথ স্বাক্ষরীত উপজেলার রাজস্ব তহবিলের ব্যাংক হিসাবের ১৯টি চেকের পাতা ছিঁড়ে ফেলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েস। যা নিয়েও আদিতমারী থানায় জিডি(নং ৫৫৯) করেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের স্টানোটাইপিষ্ট হাবিবুর রহমান।
এদিকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে এবার পাল্টা দুটি লিখিত অভিযোগ জেলা প্রশাসকে দিয়েছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েস। সোমবার (১৬ নভেম্বর) বিকাল ৪টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফরের কার্যালয়ে দেখা করে ইউএনও মনসুর উদ্দীনের বিরুদ্ধে লিখিত আকারে দুটি অভিযোগ দেন উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েস।
চেয়ারম্যান ফারুক বলেন, তাকে হেয় করতে ইউএনও উঠেপড়ে লেগেছেন। সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল মাত্র। আর চেকের পাতা ছেড়ার বিষয়টিও ভিত্তিহীন। ষড়যন্ত্র করে স্টেনো টাইপিস্টকে দিয়ে জিডি করানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন।