বিজনেস ফাইল প্রতিবেদক
কোনো কর্মকর্তা অবসরে গেলে স্বাভাবিকভাবেই নিচের পদের যোগ্য কাউকে পদোন্নতি দিয়ে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংস্কৃতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী; কিন্তু বাস্তবে সে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে যেভাবে একের পর এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন আসছে, তাতে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে প্রশাসনে। স্বপ্নভঙ্গে হতাশার সুর কর্মকর্তাদের অনেকের কথায়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৮৫ জন কর্মকর্তার মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ দুই পদসহ ১৭ জনই চুক্তিতে কর্মরত। শুধু গত মাসেই (জুন) প্রশাসনের শীর্ষ একটি পদসহ অন্তত চারটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়েছে। সর্বশেষ ৪ জুলাই জ্যেষ্ঠ সচিব মর্যাদায় সাবেক জননিরাপত্তা সচিব মোস্তাফিজুর রহমানকে দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির ‘প্রধান পরামর্শক’ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৫ জুলাই চুক্তিতে চাকরির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয় পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের। শিগগিরই আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শূন্যপদ পূরণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে প্রশাসনে এক ধরনের ছন্দপতন ঘটে। চুক্তির ফলে শীর্ষ পদগুলোয় বছরের পর বছর একই ব্যক্তি আসীন থাকায় পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা হতাশ হন। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে প্রশাসনে। কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের স্পৃহা কমে যায়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। যাঁদের পুনর্নিয়োগ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে অপরিহার্য বলে মনে হয়, কেবল তাঁরাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান, এটিই প্রত্যাশিত।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেশি হলে পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা হতাশ হন। এ হতাশা প্রশাসনের জন্য ক্ষতিকর। ফলে যোগ্য লোক তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন।
গত জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠনের পর প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অনেকটাই কমেছিল। রেলসচিব ড. হুমায়ূন কবীর ও কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার ছাড়া কাউকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এরপর হঠাৎ করে গত মাসে চারজনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়াও চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া অন্য তিন কর্মকর্তা হলেন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন।
আগামী অক্টোবরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। চলতি বছর আরও যাঁদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে বা স্বাভাবিক অবসরে যাবেন তাঁরা হলেন ওএসডি সচিব খাজা মিয়া, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, যুব ও ক্রীড়াসচিব ড. মহীউদ্দীন আহমেদ, বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হাবিবুর রহমান, ধর্মসচিব মু. আবদুল হামিদ জমাদ্দার, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আবদুল বাকী, ভূমিসচিব খলিলুর রহমান, পূর্তসচিব নবীরুল ইসলাম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, বিমানসচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ, আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমদ ও বাণিজ্যসচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন।
ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচজন চুক্তিতে নিয়োগ পেতে পারেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মুখ্যসচিবের সিনিয়র কোনো কর্মকর্তাই মন্ত্রিপরিষদ সচিব হন। বর্তমান মুখ্য সচিব বিসিএস নবম ব্যাচের কর্মকর্তা, আর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন অষ্টম (১৯৮৬ ব্যাচ) ব্যাচের কর্মকর্তা। সেই বিবেচনায় বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর।
এদিকে বিসিএস ১৫তম ব্যাচের তিনজন ইতিমধ্যে সচিব হয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে এ ব্যাচসহ ১৩তম ব্যাচ থেকে সচিব হওয়ার কথা। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে এই দুই ব্যাচের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই ক্ষুব্ধ। এতে তাঁদের পদোন্নতি ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, একটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলে অন্তত চার-পাঁচজন কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হন। তাঁদের চাকরিজীবনের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে। কিন্তু একের পর এক চুক্তিতে নিয়োগের কারণে প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে গত জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন। তৃতীয় মেয়াদের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। গত ২৭ মে সচিবালয়ে ‘বিএসআরএফ সংলাপ’-এ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সব সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করেন। বর্তমানে যাঁরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন, তাঁদের চুক্তির মেয়াদ শেষে সেখানে নতুন অনেককে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আমরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সব সময় নিরুৎসাহিত করি। প্রধানমন্ত্রীরও অনুশাসন আছে। কারণ একজনকে নিয়োগ দিলে এক্ষেত্রে কিন্তু যাঁর সুযোগ ছিল, তিনি হয়তো বঞ্চিত হন। প্রধানমন্ত্রী সব সময় বিষয়টি খেয়াল রাখেন।’