আলি জামশেদ, হাওর অঞ্চল থেকে
কিশোরগঞ্জের নিকলীতে বিএনপির পদ নিয়ে অনিয়ম বানিজ্যে অভিযোগে তোলপাড় গোটা উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে পর্যন্ত। ইউনিয়ন কমিটি গঠনের বিষয়ে ভোটারদের উপস্থিতিতে কাউন্সিলের নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে কমিটি গঠনের দায়িত্বে থাকাদের একান্ত সিদ্ধান্ত। এই সুযোগে হয়েছে ব্যাপক বানিজ্য ও স্বজনপ্রীতির অনিয়ম। প্রবাসে অবস্থানকারী আর আ’লীগ সমর্থনকারী নেতাকর্মীরাও ভাগিয়ে নিয়েছেন বিএনপির পদ-পদবী। এমন অভিযোগ অধিকার বঞ্চিত স্থানীয় রাজনৈতিক বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে। নিকলীর জারইতলাতে মানববন্ধনের মধ্যে দিয়ে এমন বাস্তবতা তুলে ধরেন অধিকার বঞ্চিত বিএনপির একাংশের নেতা-কর্মী ও তার অঙ্গ সংগঠনের সাথে জড়িতরা ।
দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের কাছাকাছি সময়ে নানান সুবিধা বঞ্চিত, জেল জুলুমের শিকার রাজনৈতিকভাবে সর্ব বৃহৎ ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরাসরি এখনো ক্ষমতার সাধ গ্রহন করতে না পারলেও পরোক্ষভাবে নানাবিধ সুবিধা নিয়ে চলেছে গত ৫ আগষ্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর থেকে। যে কারণে অসাধু আ’লীগের সমর্থনকারীরা এমনকি কিছু সংখ্যক নেতাকর্মীও এবার মরিয়া হয়ে উঠেছে অর্থের বিনিময়ে পদ-পদবী ভাগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে। পদ ভাগিয়ে নিতে পারলেই আবারো সুবিধা নিবেন বিএনপি নেতা সেজে। এমনি মানসিকতা পোষণকারীদের ঘিরে ব্যাপক সমালোচনায় রয়েছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মাঝে। আলোচনা ও সমালোচনা দুটোই রয়েছে জনপ্রিয় এ দলের বিভিন্ন কার্যকলাপককে কেন্দ্র করে। নিকলীতে অনিয়ম বানিজ্যের অভিযোগে কমিটি গঠন বিষয়ে দুর্নীতি চরমে বলেও ইঙ্গিত করেন আলমসহ অসংখ্য স্থানীয় নেতাকমী। ক্ষোভের ভাষায় অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় জেল, জুলুম আর নির্যাতনের পরেও যদি প্রতিদ্বন্দ্বী অসাধু আ’লীগ নেতাকর্মীদের দলে টেনে রাখে তাহলে বিএনপি ও তার দলের জন্যে ভবিষ্যৎ খাল কেটে কুমির আনার সামিল বলে উল্লেখ করেন। পকেট ভারী করে চলা নেতাকর্মীদের প্রতি অসন্তোষের চিত্রও উঠে আসে এ সময়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আ’লীগ নেতাকমী ও প্রশাসনের অসাধু লোকদের দ্বারা দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ সময়ের মধ্যে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়েছে সারা দেশের ন্যায় কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা বিএনপির ও তার সহযোগী অঙ্গসংগঠন ও সমমনা তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে বিএনপির সমর্থনকারী আপামর জনগণ। দুর্নীতি করে আ’লীগ নেতাকর্মীদের অনেকেই গড়ে তুলেছেন কারি কারি টাকা। অপরাধের দায়ে অনেকে বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকে আবার বিএনপির সাথে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে লিঁয়াজো করে চলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে অর্থের বিনিময়ে বিএনপিতে পদ পদবী ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়ও লিপ্ত রয়েছেন সুবিধাভোগী আ’লীগ নেতাকর্মীদের একাংশের অসাধু।
সাম্প্রতিক কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলীর ৭টি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত করাকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সুবিধা নেয়ার বিষয়ে ঝড় উঠেছে দায়িত্বে থাকা স্থানীয় উপজেলা আহবায়কসহ বেশ কিছু নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। নিকলীর কমিটি গঠন বিষয়ে জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচনা রয়েছে লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতেও মেলেনি কোন প্রতিকার!
গত ১৫ নভেম্বর নিকলী উপজেলার জারইতলা ইউনিয়নে দ্বি-বার্ষিক কর্মী সম্মেলন ও কমিটি গঠন উপলক্ষে কাউন্সিলর হয় উপজেলার অন্যান্য কমিটির ন্যায় আঠার বাড়িয়া ইউপি কমপ্লেক্সে ভবনের সামনেও। উক্ত কাউন্সিলে কমিটি গঠন না করে বরং কমিটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এই নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে সমালোচনার গুঞ্জন ছিল। জানা গেছে জারইতলাতে ৯টি ওয়ার্ডে সভাপতি ও সেক্রেটারির সংখ্যা ১৮। এছাড়াও কাউন্সিলে মোট ভোটার সংখ্যা ৪৫৯ জন। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য মিলেছে নির্বাচন চেয়ে ৯টি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সেক্রেটারীসহ ১২ জনের স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন ১৬ নভেম্বর উপজেলার আহবায়ক বরাবরে। এই বিষয়ে অনুলিপি দিয়েছেন জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটি বরাবরে। এ সবের পরেও অর্থনৈতিক ফায়দা লুটার উদ্দেশ্যে কমিটি গঠন করা হয় ঢাকাতে বসে। সুযোগে অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে সৌদি আরবে অবস্থান করেও নিকলী জারইতলার সাহাপুরের জাকির হোসেন সভিপতি কামরুলের ইচ্ছেতে সাংগঠনিক যুগ্মসম্পাদক পদ ভাগিয়ে নিয়েছেন বলে। এমনকি ইউনিয়ন বিএনপির সেক্রেটারী শাহ জাকির হোসেন এবং সভাপতি কামরুল ইসলামসহ কমিটি গঠনের অনিয়ম বানিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন স্থানীয় রোদার পুড্ডা বাজারের সংবাদ সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে। এ সময়ে বক্তব্যরা বিতর্কিত লোকদের হাতে অর্থনৈতিক সুবিধার মোহে পদ পদবী তুলে ধরাকে কলঙ্কজনক বলেও উল্লেখ করেন।
সমালোচনা উঠেছে নিকলী সদরের ৪নং ওয়ার্ডের বিএনপির সদস্য হিসেবে সুমান সাহাকে স্বীকৃতি দেয়া প্রসঙ্গে। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দক্ষিণ কোরিয়া হতে আসার পরে সুমন আ’লীগের পক্ষে হিন্দুদের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম ভূমিকায় ছিলেন। আ’লীগ এমপি আফজালের ডোনার ও সমর্থনকারী হিসেবে যিনি খ্যাত। মাল্যদানের স্থির চিত্রও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। এবার তিনি বিএনপি নেতা।
বিএনপি পদে থাকার বিষয়ে স্বীকার করলেও তিনি আলীগে নেই বলে জানান। পাশাপাশি সৌদি আরবে অবস্থানকারী সাহাপুরের ৯ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দেয়ার বিষয়েও দলকে ঘিরে সমালোচনা উঠেছে। কমিটিকে কেন্দ্র করে এমন অসংখ্য অভিযোগের বাস্তবতা মিলেছে সরেজমিনে। তাছাড়া অর্থের বিনিময়ে জারইতলা ইউনিয়ন বিএনপির পদ ভাগিয়ে নেয়া সেক্রেটারী জাকির হোসেনকে নিয়েও সংবাদ সম্মেলনে সমালোচনা করেন নেতাকর্মীরা।
৫ নং জারইতলা ইউনিয়ন বিএনপির সেক্রেটারী বিতর্কিত শাহ মোহাম্মদ জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিনি পদ ভাগিয়ে নিয়েছেন এমন কথা সম্পূর্ণই অস্বীকার করে চলেছেন।
সাবেক থানা বিএনপির দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক, তাতী দলের সভাপতি আলম মিয়া ৩ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে বিতর্কিত লোকদেরকে কমিটির পদ দিয়েছেন বলে বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। হঠাৎ করে আলীগ পরিবারের জাকিরের মতো বিতর্কিত লোকেরা সেক্রেটারি পদ ভাগিয়ে নেয়াকে দলের জন্যে কলঙ্কজনক বলেও উল্লেখ করেন।
জারইতলা ইউনিয়নের সাবেক ৪বারের ইউপি সদস্য ও ৩ বারের ইউনিয়ন বিএনপির নির্বাচিত সভাপতি উল্লেখ করে নুরুল আমিন স্পষ্টভাবেই বলে চলেছেন কমিটি নিয়ে অনিয়ম বানিজ্য হয়েছে। তাই তিনি এই বছর সভাপতি হতে পারেননি।
৫নং জারইতলা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কামরুল ইসলাম অতীতে আ’লীগ নেতাকর্মীদের সাথে লিঁয়াজো করে চলার বিষয়ে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে তিনি সভাপতি বনে যাননি বলেও দাবি করেন। এছাড়াও তার যোগসাজশে অর্থর বিনিময়ে সৌদি অবস্থানরত জাকিরকে পদ পেতে সহায়তা করেননি বলে জানান।
নিকলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বদরুল মোমেন মিঠু কমিটি গঠনের বিষয়ে বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে যখন কমিটি গঠন করা হয় তখন মুলত দুটো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়। স্থানীয়দের অধিকাংশের দাবীর উপরই নির্ভর করে কোন পদ্ধতিতে হবে। নিকলীর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও জেলা উপজেলার নেতৃবৃন্দের পরামর্শ অনুযায়ী সিল ও ভ্যালট পেপার সঙ্গে নিয়ে আসার কথাও স্বীকার করেন।
তবে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু প্রভাব প্রতিপত্তির কথা স্বীকার করলেও তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক লেনদেন আর স্বজনপ্রীতির অনিয়ম অভিযোগের কথা অবান্তর ও গুঞ্জন বলে উড়িয়ে দেন।
মায়মনসিংহের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলকে তার একাধিক নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও পাওয়া যায়নি।