
বাংলাদেশ স্কাউটস হলো দেশের সবচেয়ে বড় যুব সংগঠন, যার মূল উদ্দেশ্য তরুণ প্রজন্মকে শৃঙ্খলাবদ্ধ, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক ও মানবসেবায় নিবেদিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। স্কাউট আন্দোলন কেবল একটি সংগঠন নয়; এটি একটি জীবনদর্শন, যা মানুষকে আত্মনির্ভরশীল, সৎ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে শেখায়।
স্কাউট আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডে লর্ড রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েলের হাত ধরে। তার বই “Scouting for Boys” প্রকাশের মাধ্যমে স্কাউট আন্দোলনের বিশ্বব্যাপী যাত্রা শুরু হয়।
ভারতে স্কাউট আন্দোলন আসে ১৯০৯ সালে, এবং তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের মাটিতে স্কাউট কার্যক্রম শুরু হয় ১৯১৪ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান স্কাউট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হলে, পূর্ব পাকিস্তানেও এর কার্যক্রম চলতে থাকে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে “বাংলাদেশ স্কাউটস” নামে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ স্কাউটস বিশ্ব স্কাউট আন্দোলনের (WOSM) পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে, যা দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন।
বাংলাদেশ স্কাউটসের মূল লক্ষ্য হলো –
“যুব সমাজকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে বিকশিত করে একজন ভালো মানুষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।”
এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সংগঠনটি কয়েকটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে থাকে, যেমন –
দায়িত্ববোধ ও শৃঙ্খলা সৃষ্টি
মানবতা, দেশপ্রেম ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চা
সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি
নেতৃত্ব ও দলগত কাজের দক্ষতা বিকাশ
প্রত্যেক স্কাউট সদস্যকে একটি শপথ গ্রহণ করতে হয়, যা তাদের জীবনের আদর্শ হিসেবে কাজ করে:
স্কাউট শপথ:
“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব—
আমার কর্তব্য পালন করতে,
আল্লাহ্ ও দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে,
সর্বদা অন্যকে সাহায্য করতে,
এবং স্কাউট আইন মেনে চলতে।”
বাংলাদেশ স্কাউট আইন অনুযায়ী একজন স্কাউট – সত্যবাদী, কর্তব্যনিষ্ঠ, ভদ্র, দেশপ্রেমিক, সাহসী, সহনশীল, পরিবেশপ্রেমী এবং পরোপকারী।
বাংলাদেশ স্কাউটস একটি জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন, যার কাঠামো নিচের মতো:
জাতীয় সদর দপ্তর: ঢাকায় অবস্থিত, যা পুরো দেশের স্কাউট কার্যক্রম পরিচালনা করে।
আঞ্চলিক (Region) কার্যালয়: ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
জেলা স্কাউটস: প্রতিটি জেলায় জেলা স্কাউট সদর দপ্তর রয়েছে।
উপজেলা স্কাউটস: উপজেলা ও থানা পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট: স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় স্কাউট ইউনিট রয়েছে।
বর্তমানে (২০২5 সাল অনুযায়ী) বাংলাদেশ স্কাউটসের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২২ লাখেরও বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ স্কাউট সংগঠন।
বাংলাদেশ স্কাউটসের কার্যক্রম মূলত চারটি স্তরে পরিচালিত হয়:
কাব স্কাউট (৬–১০ বছর)
স্কাউট (১১–১৭ বছর)
রোভার স্কাউট (১৮–২৫ বছর)
প্রাপ্তবয়স্ক নেতা ও কর্মকর্তা
প্রতিটি স্তরে প্রশিক্ষণ, সামাজিক সেবা, ক্যাম্প, গেমস, ও নেতৃত্বমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমগুলো হলো:
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জাম্বুরি
কমিউনিটি সার্ভিস প্রজেক্ট
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম
বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মসূচি
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম
বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও কোভিড-১৯ এর সময় স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ
বাংলাদেশ স্কাউটস জাতীয় পর্যায়ে যেমন সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে।
বিশেষ করে, ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরিতে অংশগ্রহণ করছে।
এর পর, ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ২৪তম এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক স্কাউট সম্মেলন।
পাশাপাশি, ২০১২ সালে বাংলাদেশ স্কাউটস আয়োজিত করে ২০তম এশিয়া-প্যাসিফিক রোভার মুট।
তদুপরি, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে স্কাউটস উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
বাংলাদেশ স্কাউটস শুধু প্রশিক্ষণভিত্তিক সংগঠন নয়, বরং এটি দেশের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধানেও কাজ করছে।
এছাড়াও সমাজসেবায় স্কাউটদের ভূমিকা:
গ্রামীণ এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে রাস্তা ও সেতু নির্মাণ।
বিদ্যালয় ও হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি।
রক্তদান ও জনসচেতনতা কার্যক্রম।
দুর্যোগকালে উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ।

এছাড়া, স্কাউটরা নিয়মিতভাবে জনস্বাস্থ্য সচেতনতা, ডিজিটাল শিক্ষা, এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করছে।
বাংলাদেশ স্কাউটস একটি সরকারি পৃষ্ঠপোষক সংগঠন, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রধান স্কাউট (Chief Scout) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, এবং শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমানে সরকার স্কাউট আন্দোলনকে আরও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্কাউট ইউনিট গঠন বাধ্যতামূলক করেছে।
বাংলাদেশ স্কাউটসের রয়েছে বেশ কিছু আধুনিক প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পিং কেন্দ্র, যেমন—
জাতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মউলভীবাজার
মীরেরসরাই স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম
রাজশাহী স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
গাজীপুর জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
এখানে নিয়মিতভাবে স্কাউট লিডার প্রশিক্ষণ, ক্যাম্পোরি, এবং রোভার মুট অনুষ্ঠিত হয়।
ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশ স্কাউটস নতুন প্রজন্মকে প্রযুক্তি, নেতৃত্ব ও সামাজিক উদ্ভাবনে দক্ষ করে তুলছে।
ভবিষ্যৎ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে –
প্রতিটি বিদ্যালয়ে অন্তত একটি স্কাউট ইউনিট স্থাপন।
নারী স্কাউট সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি।
অনলাইন স্কাউটিং ও ডিজিটাল প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা উন্নয়ন।
আন্তর্জাতিক স্কাউট সহযোগিতা জোরদার।
বাংলাদেশ স্কাউটস শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি একটি আন্দোলন—একটি জীবনদর্শন, যা তরুণদের আদর্শ নাগরিক হতে উদ্বুদ্ধ করে। দেশের প্রতিটি কোণে স্কাউটরা সমাজের কল্যাণে কাজ করছে নীরবে, নিঃস্বার্থভাবে। স্কাউট আন্দোলন যত বিস্তৃত হবে, ততই গড়ে উঠবে শৃঙ্খলাবদ্ধ, দায়িত্বশীল ও মানবিক বাংলাদেশ।
সকল আপডেট জানতে চােখ রাখুন দৈনিক বিজনেস ফাইল পত্রিকার ওয়েব পেইজে
আপনার মতামত লিখুন :