আবু সাঈদ খান
রাষ্ট্রপতির থাকা-না থাকা নিয়ে বিতর্ক থামছে না, বরং নতুন নতুন ডালপালা মেলছে। ক’দিন আগে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি। সেই থেকে বিতর্কের সূত্রপাত। যদিও ৫ আগস্ট দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আড়াই মাস পর রাষ্ট্রপতির নতুন তথ্যকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মিথ্যাচার ও শপথভঙ্গের শামিল বলেছেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর অবস্থানে থাকেননি। তিনি এটিকে মীমাংসিত সত্য বলে বিবৃতিও দিলেন। এতেও পরিস্থিতি শান্ত হলো না। প্রতিবাদের ঝড় বইছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে অনড়।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করা-না করার বিষয়টি এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে। গত ২৪ অক্টোবর প্রেস ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ প্রশ্নে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।’ (সমকাল ২৪ অক্টোবর ২০২৪)। বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দলটি নতুন করে কোনো সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রিক সংকট চায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। তারপর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করা-না করা বিতর্ক অবান্তর। এর কোনো প্রয়োজন নেই।
বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দোসর। এতে সন্দেহ নেই। তবে সেই অজুহাতে তাঁকে সরালে যে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে; সেটিই আজ প্রধান বিবেচ্য।
রাজনৈতিক দাবি এখন রাষ্ট্রপতির থাকা-না থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গত ২২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জমায়েতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে পাঁচ দফা দাবি করেছে; এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ছাড়াও চারটি দাবি রয়েছে। তা হচ্ছে– ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, নতুন সংবিধান প্রণয়ন, প্রক্লামেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা; ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা। এই তিন নির্বাচনে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় অযোগ্য ঘোষণা করা।
ইতোমধ্যে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্রলীগ কেবল সন্ত্রাসী সংগঠন নয়; ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তারা অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমেছে; ছাত্র-জনতার বুকে গুলিও চালিয়েছে। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। এ অপরাধের বিচার হওয়া উচিত। তবে নিষিদ্ধ ঘোষণা কোনো কার্যকর সমাধান নয়। বরং নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে অনেক অপকর্ম আড়াল হয়ে যেতে পারে। এক ধরনের সুবিধাও পেতে পারে। তাই নিষিদ্ধ নয়, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলাই হচ্ছে সঠিক পথ।
নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবিও নতুন নয়। কবি-লেখক ফরহাদ মজহার নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি তুলে আসছেন। অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলেছেন। আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ একই কথা বলেছেন। তবে তা ছিল একাডেমিক আলোচনার মতো। আন্দোলনকারী ছাত্রদের পক্ষ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এ ব্যাপারে কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। ২৪ অক্টোবর বাংলা একাডেমিতে ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা, আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনায় বলেছেন, ‘৫ আগস্ট সেনাপ্রধানের আহ্বানে বিএনপি-জামায়াত গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চও গেছে। জাতীয় পার্টির তিন ভাগ গেছে। আমি এক কোনায় বসেছিলাম। কোনো দলই বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা বলেনি।’ (সমকাল, ২৫ অক্টোবর ২০২৪)। এ বক্তব্যের মধ্যে সেদিনের বাস্তবতার প্রতিফলন রয়েছে।
৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ। একদিকে সীমাহীন লুটপাটের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে; বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না। ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়েছিল। ফরিয়াদ জানানোর সুযোগও ছিল না। ভোটের সময় নেতাদের কাছে সুখ-দুঃখের কথা জানানোর রেওয়াজ ছিল; শেখ হাসিনার শাসনামলে সেই সুযোগও ছিল না। পরপর তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন হলো। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না; গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠিত হয়েছিল। হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী হয়েছিল জেল-জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতন, গুম ইত্যাদির শিকার। তাই সেদিন সব মানুষের, সব শ্রেণির ক্ষোভ এক রেখায় মিলেছে। শিক্ষার্থীদের পাশে অভিভাবক, শিক্ষক, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, শ্রমিক, দোকানি, কেরানি সবাই মিছিলে যোগ দিয়েছেন। যার ফলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ সব সাঙ্গোপাঙ্গ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এটি অভূতপূর্ব ঘটনা। বিস্ময়কর গণজাগরণ। এ ঘটনাকে মহিমান্বিত করতে অনেকে এটিকে বিপ্লব বলেছেন। কেউ আবার দ্বিতীয় স্বাধীনতাও বলেছেন। তবে এটি ফরাসি বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লবের মতো বিপ্লব নয়। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন এসেছিল। অক্টোবর বিপ্লব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রে ছিল দীর্ঘ সংগ্রাম ও পরিকল্পনা। সেখানে পরীক্ষিত ও পোড় খাওয়া নেতৃত্বও ছিল। যে নেতৃত্ব ক্ষমতা দখলের পর বিপ্লবী সরকার গঠন করে। যা বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ছিল না। তাই ৫ আগস্ট সংশ্লিষ্ট কারও মনে বিপ্লবী সরকার গঠন বা ‘প্রক্লামেশন অব রিপাবলিক’-এর কথা উদয় হয়নি। সেদিন সবার ভাবনায় ছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তাই ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এটি ছিল উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাস্তব সমাধান।
রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যদের শপথ পড়ান। প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা সংবিধান অনুসরণের শপথ নেন। সরকার গঠনে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটলেও সংবিধানের পথে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের অনুমোদনও নেওয়া হয়।
বলা বাহুল্য, এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতাও নয়। স্বাধীনতা কোনো জাতির জীবনে বারবার আসে না। আমাদের স্বাধীনতা এসেছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে; লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে। এ ঘটনা আর কোনো ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ১৯৭২ সালের সংবিধান। বিগত ৫৩ বছর ধরে শাসকগোষ্ঠী হীন স্বার্থে সংবিধান কাটাছেঁড়া করেছে। ফলে সংবিধান এখন অনেক অগণতান্ত্রিক বিধান ও কালাকানুনের বেড়াজালে বন্দি। এখন প্রয়োজন সংবিধানের অগণতান্ত্রিক বিধানের বিলোপ ও গণতন্ত্রায়ন। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। তাই আলোচ্য বিষয় হওয়া দরকার, নির্বাচনী আইন ও সংবিধানে কী কী সংস্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন কীভাবে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এবার আসা যাক ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে। এই তিনটি নির্বাচন যে অবৈধ ছিল– তা নিয়ে সংশয় নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছিল এবং ২০২৪ সালের আমি আর ডামির নির্বাচন। এই তিন নির্বাচনের পরিকল্পনাকারী ও অনুঘটকদের বিচার হতে পারে। হওয়াই উচিত। তবে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন– এ কারণে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? ১৬ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপি নেতা হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানাও সংসদ সদস্য ছিলেন। তাদের সম্পত্তি কি বাজেয়াপ্ত হবে?
পরিশেষে বলতে চাই, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, তা সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে হবে। অতি দ্রুততার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, বাজারসহ অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে হবে। পুলিশ-প্রশাসন-সংবিধান-নির্বাচনী ব্যবস্থারও যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। তাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। সংস্কার একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। নির্বাচিত সংসদই এর সঠিক কারিগর।
অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনের পথরেখা ঘোষণা করা; সেটিই সময়ের দাবি।
লেখক: লেখক ও গবেষক; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
ask_bangla71@yahoo.com