বিজনেস ফাইল প্রতিবেদক
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমান ও প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুস লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানেই তাদের শত শত কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তারা নিজেদের নামে সম্পদ করেছেন কম। বেশি করেছেন স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের নামে।
এদিকে দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফয়সালের চেয়েও ধূর্ত মতিউর। দুদক ইতোমধ্যেই মতিউর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যের আয়কর নথি সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করছে। গত ৩ বছরের আয়কর নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে মতিউর তার কোনো সম্পদ কারও নামে হস্তান্তর করেছেন কিনা তা নথিতে উল্লেখ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অত্যন্ত ধূর্ত মতিউরের কূটকৌশল ধরতে হলে তার আরও পুরোনো আয়কর ফাইল সংগ্রহ করতে হবে।
তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুদক নিশ্চিত হয়েছে, ফয়সালের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন মতিউর। নিজের নামে মাত্র ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি আয়কর ফাইলে দেখিয়েছেন। বাকি কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ করেছেন স্ত্রী-সন্তান, ভাই ও আত্মীয়স্বজনের নামে। এছাড়া দেশের তিন বড় শিল্প গ্রুপে চুক্তিপত্র দলিলের মাধ্যমে মতিউরের প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে দুদক। এ তথ্য যাচাই-বাছাই ও দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে।
পুরো পরিবার ধনী : আয়কর ফাইল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মতিউরের অপরাধলব্ধ আয়ে পরিবারের উপার্জন নেই এমন সদস্যদের নামেও শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েও হয়েছেন শতকোটি টাকার মালিক। কলেজ শিক্ষক ও গৃহিণী স্ত্রীদের নামেও প্লট, ফ্ল্যাট, জায়গা-জমির ছড়াছড়ি। ২০২৩ সালে মতিউরের প্রথম পক্ষের কানাডা প্রবাসী মেয়ে ইপ্সিতা তার আয়কর নথিতে ৪২ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে সাত কোটি টাকা বিনিয়োগ দেখিয়েছেন ৫টি কোম্পানিতে। নরসিংদী, গাজীপুর ও ঢাকায় জমি ও বাড়ির দাম দেখিয়েছেন প্রায় ১৩ কোটি টাকা। প্রকৃত অর্থে এসব সম্পদের দামই ৭০ কোটি টাকার বেশি।
আয়কর নথিতে আরও দেখা গেছে, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র, নিজের কোম্পানিকে দেওয়া ঋণ ও ভাইকে দেয়া ধার বাবদ তার সম্পদ আছে ২২ কোটি টাকার। নরসিংদীতে হেবামূলে দেড় একর জমির মালিক ইপ্সিতা। আয়কর নথিতে এই জমির বর্ণনা দেয়া থাকলেও দাম উল্লেখ করা হয়নি। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৫ কাঠা জায়গায় নির্মিত বিলাসবহুল সাত তলা বাড়ির দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা। নীলক্ষেতে পার্কিং স্পেসসহ দেড় হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ৬০ লাখ টাকা।
মেয়ের মতো মা লায়লা কানিজ লাকীরও অঢেল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। আয়কর নথিতে তার মাত্র ১২ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য আছে। বিপরীতে তিনি ২ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ দেখিয়েছেন। এছাড়া ভাই কাইয়ুম হাওলাদার ও নূরুল হুদার নামেও বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট, একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টসহ বিপুল সম্পদ করেছেন মতিউর।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মতিউরকে আইনের জালে আটকাতে হলে গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। কারণ তিনি নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে দুই পক্ষের স্ত্রী-সন্তান ও ভাই, ভায়রাসহ আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
তবে তিনি নিজেকে রক্ষায় বরাবরের মতোই প্রভাবশালী মহলে তদবিরে নেমেছেন। গণমাধ্যমে তাকে ও তার পরিবারকে নিয়ে যাতে সংবাদ প্রচার না হয় সে চেষ্টাও চালাচ্ছেন। তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী প্রকাশ্যেই বলেছেন, ঢাকার ও নরসিংদীর টেলিভিশন ও পত্রিকার বড় বড় সাংবাদিকদের ম্যানেজ করেই রায়পুরায় গেছেন। আর কিছু হবে না। সব থেমে যাবে বলেও দম্ভোক্তি করেছেন তিনি।
দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৫ সালে বিসিএস (কর) ক্যাডারে সহকারী কর কমিশনার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন ফয়সাল। বর্তমানে তিনি এনবিআরের আয়কর বিভাগের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) হিসাবে দায়িত্বরত। চাকরি জীবনে ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ উপার্জন করেছেন। তার অপরাধলব্ধ অর্থই শ্বশুর-শাশুড়ির নামে করা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা হয়েছে। গত বছর থেকে দুদক ফয়সালের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে।
প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে বৃহস্পতিবার ফয়সাল ও তার আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদের বিবরণী আদালতের কাছে তুলে ধরে তা ক্রোক ও জব্দ করার আবেদন করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
ফয়সালের যত সম্পদ : আদালতে দাখিল করা দুদকের আবেদনে দেখা গেছে, ফয়সাল, তার স্ত্রীর নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৫ কাঠার দুটি প্লট কিনেছেন। সিদ্ধেশ্বরীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উলটো পাশে রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয় ভবনে তিন হাজার স্কয়ার ফুটের অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন শ্বশুরের নামে। খিলগাঁওয়ে শাশুড়ির নামে কিনেছেন ১০ কাঠার প্লট। শ্বশুর-শাশুড়ির নামে শুধু প্লট-ফ্ল্যাট কেনেননি, তাদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ১৮টি অ্যাকউন্ট করে ঘুসের ১৯ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। ফয়সাল ও তার পরিবারের নামে ৮৭টি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। স্থাবর-অস্থাবর এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন।
দুদক সূত্র জানায়, ফয়সালের শ্বশুরের নাম আহম্মেদ আলী। তিনি খুলনার খালিসপুরের বাসিন্দা। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। আর শাশুড়ি মমতাজ বেগম গৃহিণী। এরা ছাড়াও ফয়সাল ও তার ১১ স্বজনের নামে ১৯টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে তার শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে। ফয়সাল তার অপরাধলব্ধ আয় লুকানোর জন্য স্বজনদের নামে ৭শর মতো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এর মধ্যে ৮৭টি অ্যাকাউন্টে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুদক।
আদালতে জমা দেয়া দুদকের নথিতে বলা হয়েছে, ফয়সাল, তার স্ত্রী আফসানা জেসমিন, ফয়সালের ভাই কাজী খালিদ হাসান, শ্বশুর আহম্মেদ আলী, শাশুড়ি মমতাজ বেগম, শ্যালক আফতাব আলী, খালাশাশুড়ি মাহমুদা হাসান, মামাশ্বশুর শেখ নাসির উদ্দিন, আত্মীয় খন্দকার হাফিজুর রহমান, রওশন আরা খাতুন ও ফারহানা আফরোজের নামে ব্যাংক হিসাব খুলে অপরাধলব্ধ আয় লেনদেন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফয়সালের নামে ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ২১ লাখ ও ফয়সালের স্ত্রী আফসানা জেসমিনের পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা জমা হয়। ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলীর আটটি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ১০টি ব্যাংক হিসাবে ৭ কোটি টাকা জমা হয়। এছাড়া ফয়সালের শ্যালক আফতাব আলীর ৬টি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বিভিন্ন সময়ে এসব টাকা জমা হওয়ার পর বেশিরভাগই তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে লেনদেনের পর ফয়সাল, তার স্ত্রী, শ্বশুর ও তার স্বজনদের ১৯টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এখনো প্রায় ৭ কোটি টাকা স্থিতি আছে। এছাড়াও তাদের নামে রয়েছে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।