আলি জামশেদ, (কিশোরগঞ্জ) হাওর অঞ্চল থেকে
কিশোরগঞ্জে হাওয়র অঞ্চলে দুই ফসলি ও তিন ফসলি কৃষি জমির উর্বর মাটি কাটা থামানো যাচ্ছে না।
প্রশাসনের তদারকির অভাবে দিন-রাত সমান তালে চলছে কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার মহোৎসব। জমির টপ সয়েল ইটভাটায় সরবরাহে আইনি বিধিনিষেধ থাকলেও ভাটা মালিক কিংবা প্রশাসন কেউই তা মানছে না। ফলে প্রতিদিন একরের পর এক কৃষি জমির টপ সয়েল চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। এতে করে যেমন জমি উর্বরাশক্তি হারাচ্ছে তেমনি ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) তথ্যমতে হাওরের রাস্তাগুলোর ধারণক্ষমতা ৮ টন। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাটি বোঝাই করা ওভারলোডেড গাড়ী চলাচলের কারণে গাড়ীর সারফেস পেভমেন্ট/ পৃষ্টদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং রাস্তার আয়ুও কমে যাচ্ছে।
নিকলী ও বাজিতপুরসহ আশেপাশের বেশ কিছু স্থানে টপ সয়েল কাটার পাশাপাশি শ্রেণী পরিবর্তনের লক্ষ্যে ভ্যাকু দিয়ে মাটি কেটে সেই মাটি বিক্রির উদ্দেশ্যে হাওর থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বোঝাই করে স্থানীয় ইটভাটাসহ বাড়ি ঘরেও নিয়ে যেতেও দেখা যাচ্ছে অহরহ।
নিকলী জারইতলা ইউনিয়নের স্থানীয় বিএনপি নেতা আতিয়ার রহমান লিটনের মতো সচেতনদের একই বক্তব্য, তারা জানান, ব্যক্তিগতভাবে সামান্য পরিমাণ মাটি উত্তোলন করলেই ইউএনও তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে মোটা অংকের জরিমানা করে থাকেন। তবে নিকলীর প্রভাবশালী ইটভাটার মালিক পক্ষের নিজস্ব কয়েক ডজনের কাছাকাছি ট্রাকে করে হাওরের বুক থেকে নিয়মিত মাটি আনা-নেয়া করলেও সচরাচর তাদের ক্ষেত্রে তেমন একটা জরিমানা করতে শোনা যায়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অপরদিকে বাজিতপুর উপজেলার হিলোচিয়া ইউনিয়নের ভোল্লা মৌজার নতুন ইটভাটাসহ পুরো উপজেলায় সব মিলিয়ে ১২টি ইটভাটা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশের বৈধতা না থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নানান কৌশলে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলেও সমালোচনা রয়েছে। তবে সেখানকার প্রসাশনের ভাষ্য এসব ইটভাটার বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রতিটি ইটভাটায় নজর দিলেই ধরা পড়ে টপ সয়েলের স্তুপ। পাশেই বালিরও স্তুপ। তবে বাজিতপুর উপজেলার ইউএনওর ভাষ্য, টপ সয়েল কাটার খবর পেলেই সর্বত্র বাধা দেয়া হচ্ছে। এমনকি ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমেও ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে উল্লেখ করেন।
সরেজমিনে চলতি সপ্তাহে নিকলী-বাজিতপুরের বেশ কিছু ইটভাটা এলাকায় গেলে সচেতন জনগণকে বলতে শোনা যায় নিয়ম বহিভর্‚তভাবে ফসলি জমির উপরে চলে সেখানকার ইটভাটা। প্রশাসনের ভ‚মিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা। এ সময়ে তাদেরকে আরও বলতে শোনা গেছে, কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ থেকে শুরু করে ফসলি জমিরও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। অনেকে আবার অভিযোগ তুলছেন এলাকা ঘেঁষে, দু’ফসলি ও তিন ফসলি জমির উপর ইটভাটা স্থাপনের পর থেকে গাছের নারিকেলসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফল দায়ক গাছের মুকুলও ঝড়ে যাচ্ছে। যে কারণে ফলও তুলনামূলক কম হয়। নিকলীতে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেও রয়েছে ইটভাটা। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। স্থানীয়দের ভাষ্য অসংখ্য সময়ে অভিযোগ দিলেও প্রভাবশালীদের ইটভাটা বন্ধ হচ্ছে না।
টপ সয়েল সম্পর্কে কৃষি বিভাগের তথ্য হচ্ছে ফসলের শিখরের গভীরতার উপর নির্ভর করে টপ সয়েলের পরিমাণ নির্ধারণ। সেক্ষেত্রে বেশীরভাগই ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত ধরা হয়ে থাকে টপ সয়েলকে। তবে পাট ও ভুট্টাসহ কিছু ফসলের শিকার অধিক গভীরে চলে যাওয়ার কারণে সেক্ষেত্রে টপ সয়েল নির্ধারণ স্তরের গভীরতা কিছুটা তারতম্য ঘটে বলেও জানান।
সরেজমিনে নিকলী উপজেলার জারইতলা ও কটিয়াদী উপজেলা করগাঁও ইউনিয়নের দুই মৌজার মাঝামাঝি ভূগলির বিলেও ভ্যাকু দিয়ে মাটি কেটে শ্রেণী পরিবর্তনের প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সরকারি খাল দখল করে অসংখ্য ফিসারিজ করতে দেখা গেছে।
অসময়ে হাওরের রাস্তার বেহাল দশা নিয়ে নিকলী উপজেলা প্রকৌশলী মো. শামছূল হক রাকিবের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সাধারণত হাওরের রাস্তাগুলোর ক্যাপাসিটি ৮ টন। তবে ওভারলোডেড গাড়ী চলাচল করলে গাড়ীর সারফেস পেভমেন্ট/ পৃষ্টদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং রাস্তার আয়ু কমে যায়। বিশেষ করে মাহিন্দ্র ন্যায় মাটি, ইট, বালি ব্যবহৃত গাড়ির চাকায় অনেক বিট/ খাজ কাটা থাকে। এতে করে ভেহিকেলের লোড ডিস্টিবিউশন আন-ইভেন হয় এবং রাস্তা চলাচল অনুপযোগী হয়ে উঠে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তার বলেন, উপজেলা প্রশাসন বালু মহল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে টপ সয়েল কাটা ও শ্রেণী পরিবর্তনের বিষয়ে সব সময়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এই বিষয়ে জরিমানা এবং শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর আছে এবং তার পক্ষে কোন অনিয়ম হয়নি বলেও দাবি করেন।
বাজিতপুর উপজেলার নিবার্হী কর্মকতা ফারাশিদ বিন এনাম ইতিপূর্বে টপ সয়েল কাটার বিষয়ে সতর্ক অবস্থানের কথা জানালেও বাজিতপুরের ১২টি ইটভাটার মধ্যে কয়টির বৈধতা রয়েছে স্পষ্টভাবে এসবের তথ্য তার জানা নেই বলেও উল্লেখ করেন।
কিশোরগঞ্জের জেলা কৃষি অফিস প্রধান আবুল কালাম আজাদ বলেন, জমির টপ সয়েল বিক্রি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। এই লক্ষ্যে নিয়মিতই কৃষকদের পরামর্শও প্রদান করে থাকেন বলে উল্লেখ করেন।
কিশোরগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মমিন ভূঁইয়া বলেন, পরিবেশ দূষণের জন্যে দায়ী সবধরনের কালো ধোঁয়া। এর কুপ্রভাব প্রকৃতির উপরে পড়ে বলেও তিনি স্বীকার করেন। চলতি বছর ঝিকঝাক সরকারিভাবে বন্ধের সম্ভাবনার কথা ও জানান।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের সাথে টপ সয়েল ও ইটভাটার মাটি কাটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টপ সয়েল এবং শ্রেণী পরিবর্তন দুটোই নিষিদ্ধ। এই বিষয়ে প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে বালি মাটি উত্তোলনের কোন সুযোগ নেই কারো পক্ষে। এছাড়াও ইটভাটার বিষয়ে সার্বিক দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।