ঢাকা   ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্ষণের মহোৎসব: কোথায় যাচ্ছে দেশ?

নির্মল বার্তা
  • প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৮, ২০২০
  • 125 শেয়ার
মামুন
মামুন ফরাজী, সিনিয়র সাংবাদিক

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশে ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। পত্রিকার পাতা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর খবর জুড়ে শুধুই ধর্ষণে বিবরণ। বাস, স্কুল-কলেজ, রাস্তা, মার্কেট, মাদ্রাসা, মক্তব, গির্জা- কোথাও এখন আমাদের মা বোনরা নিরপাদ নয়। নরপিচাশদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশুরাও। যে শিশুরা সেক্স কি বিষয় বোঝে না- তারাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথে মেয়েরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। কখনও কখনও অপহরণ করে জঙ্গলে বা নিরপাদ স্থানে নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে।
বাসে ধর্ষণ এখন নতুন এক ফেনোমেনন। ২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে বাসের ভেতর সিরাজগঞ্জের মেয়ে রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যার কথা নিশ্চই অনেকের মনে আছে। কয়েকদিন কুমিল্লায় বাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গার্মেন্ট শ্রমিক। আমার ভুলে যাইনি ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির কথা। এক কুলাঙ্গার মাদ্রাসা শিক্ষক তাকে যৌন নিপীড়ন করে থেমে থাকেনি। মেয়েটিকে নিজের ভাড়াটে লোক দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় এক মাদ্রাসা শিক্ষকের কুকর্মের কথাও অনেকের মনে আছে। নিজ প্রতিষ্ঠানরে ৬ শিশু শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেছে ওই শিক্ষক। নারায়ণগঞ্জে এক কুলাঙ্গার মাদ্রাসা শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার হয়েছে অনন্ত ২০ জন ছাত্রী। প্রায়ই এ ধরনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত ৪ অক্টোবর কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক মাদ্রাসা সুপার নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। কিছুদিন আগে রাজশাহীর তানোরে গীর্জায় তিনদিন আটকে রেখে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে ফাদার।
ধর্ষণের সম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের কিছু লোক এই কাজে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। সিলেটের এমসি কলেজ হোস্টেলে গৃহবধুকে আটকিয়ে রেখে গণধর্ষণ, ঢাকার মিরপুরে তরণীকে হোটেলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা তারই প্রমাণ। এই ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতাকর্মীরা জড়িত। নোয়াখালীর এখলাসপুরে বিধবাকে বিবস্ত্র করে যারা নির্যাতন করেছে, তাদের ফেসবুক প্রফাইল ঘেটে দেখা গেছে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এই নরপিচাশদের সম্পৃক্ত রয়েছে। ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় ওরা এলাকায় নানা অপকর্ম করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিশ কেন্দ্রের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশে ৯৭৫টি নারী ও শিশু ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সংঘব্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৪জন। আর অক্টোবরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তা রীতিমতো ভীতিকর। এসবই বলে দিচ্ছে দেশে ধর্ষণের উৎসব চলছে।
কিন্তু রক্তে কেনা এই স্বাধীন এই দেশে আমাদের মা-বোন ও শিশুদের কেন এই অবস্থা? কেন তারা নিরাপত্তাহীন? কেনই বা ধর্ষকরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো? এই প্রশ্নের উত্তর হলো আমাদের সরকার কোন দৃশ্যমান বার্তা অপরাধীদের দিতে পারছে না। সিলেট ও আরও কয়েকটি ঘটনায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও সারা দেশে এ ধরনের অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, ঘুষখোর মাতুব্বর, দলকানা জনপ্রতিনিধি, পুলিশ-প্রশাসনে দুর্নীতি, অপরাধী নিজেই প্রভাবশালী হওয়া- এসব কারনে অপরাধীদের বিচার হয় না। আর বিচারহীনতার এই সংস্কৃতিই অপরাধীদের এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে উৎসাহ যোগাচ্ছে।
ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সরকারের যে ব্যর্থতা রয়েছে; তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকার যেহেতু ক্ষমতায়, তাই এর দায় সরকার এড়াবে কি করে।’ কিন্তু দায় স্বীকার করলেইতো হবে না- এ ধরনের অপরাধ থামাতে দৃশ্যমান ও চরম অ্যাকশান দরকার। বিশেষ আদালত গঠন করে অপরাধীদের দ্রæত শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। পাশাপাশি এ ধরণের অপরাধ হওয়ার পেছনের কারণ চিহ্নিত করে সে ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কিন্তু এগুলো কি আমরা দেখছি? মন্ত্রী ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিক রয়েছে। ধর্ষণের ঘটনাতো অনেক দিন ধরে চলছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে সরকারের ভূমিকা কই? মাহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় নামে সরকারের একটি মন্ত্রনালয় আছে। তারাইবা কি করছে? অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘মাদক ও পর্ণগ্রাফি ধর্ষণের প্রবনতা বাড়াচ্ছে।’ তাহলে এইগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব কার? নিশ্চই সরকারের। সরকার কি এই দায়িত্ব পালন করছে?
প্রশ্ন আসতে পারে- মাদ্রাসা কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কেন এ ধরনের অপরাধ ঘটছে? যারা ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষা নিয়ে বড় হয়েছেন এবং নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছেন- তাদের মধ্যে এই প্রবণাতা কেন? এর সহজ উত্তর হলে- শুধু ধর্ম এবং ধর্মভিত্তি সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। তাইযদি হতো সৌদি আরবে গিয়ে আমাদের বোনেরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতো না। অন্যদিকে ইউরোপের দেশ নরওয়ের কিংবা সুইডেনের দিকে তাকান। সেখানকার সমাজে আমাদের সমাজের মতো কিংবা সৌদি সমাজের মতো ধর্মীয় চর্চা নেই। অধিকাংশ মানুষ ধর্ম কিংবা পরকাল নিয়ে মাথা ঘামান না। তারপরও তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণাতা নেই। সুইডেনের কারগারগুলো খালি। কারণ অপরাধী নেই। ইতিমধ্যে অনেক কারাগার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওইসব দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বা অপরাধ নেই কেন? এর উত্তর হলো- তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। সেখানে নারীকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখা হয়। নারী ছাড়া সমাজ-সংসার-সভ্যতা যে অচল সেই বিষয়টিই তুলে ধরা হয়। ওই সমাজে নারীকে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখা হয় না। আর আমাদের সমাজে নারীকে কি হিসেবে দেখা হয়? নারীরা দুর্বল, একজন পুরুষ সমান দুইজন নারী- এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই নারীর প্রতি পুরুষের আধপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। যতদিন না আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষা ব্যবস্থা পাল্টাতে পারবো- ততদিন নারীরা নিগৃহীত হতে থাকবে।
শুধু দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষা ব্যবস্থায়ই গলদ নয়. আমাদের শাসন ও বিচার ব্যবস্থায়ও গলদ আছে। এখানে বিচার পেতে হলে অর্থ খরচ করতে হয়। কিন্তু এই সামর্থ অনেকেরই নেই। তাই তারা বিচার পান না। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া এবং বিচারকাজে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এরই মধ্যে বিচারপ্রার্থীর অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। তাই বিচার ব্যস্থারও সংস্কার জরুরি; যাতে সকলের বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকে। এটা করা গেলে নিশ্চই সমাজে অপরাধ কমে আসবে।

লেখক: মামুন ফরাজী, সিনিয়র সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২০