বিশেষ প্রতিনিধি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাতক্ষীরা জেলা কার্যালয়ের স্বেচ্ছায় অবসর নেয়া ধনকুবের অফিস সহকারী মাহমুদুল ইসলাম-এর আমলনামা অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়েছে। গত ২৪ জুলাই-২০২৪ তারিখে সাতক্ষীরার একজন বাসিন্দা মাহমুদুল ইসলাম-এর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তদন্তের দাবি জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছেন।
দুদকে প্রদত্ত আবেদনের তথ্য ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাতক্ষীরা জেলা কার্যালয়ের স্বেচ্ছায় অবসর নেয়া অফিস সহকারী মাহমুদুল ইসলাম দিনমজুর পরিবারের সন্তানের তকমা মুছে হয়েছেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। এলাকায় ধনকুবের খ্যাতি পেয়েছেন। এক সময়ে ভিটেবাড়ি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ না থাকলেও এখন সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় শপিং কমপ্লেক্স, চার তলা বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিশাল মাছের ঘেরসহ নামে-বেনামে শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। আর এসব সম্পদের উৎস নিয়ে যখন কানাঘুষা শুরু করেন স্থানীয়রা, তখনই নিজেকে রক্ষায় স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দেন। তার সম্পদের অলৌকিক সব কারবার নিয়ে এলাকায় সমালোচনা শুরু হলে চাকরি ২৫ বছর হওয়া মাত্রই তিনি ২০১৭ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। যা নিয়ে সম্প্রতি একাধিক জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
জানাগেছে, ইতিপূর্বে তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে দুদকে কয়েক দফা অভিযোগ জমা পড়লেও রহস্যজনক কারনে অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি কোনো ধরনের ব্যবস্থা। দুর্নীতি ঢাকতেই তিনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের দিনমজুর মৃত শেখ তমেজ উদ্দীনের ৩ ছেলে, ২ মেয়ের মধ্যে মাহমুদুল ইসলাম সবার ছোট। বাবার সঙ্গে এক সময় দিনমজুরির কাজ করতেন। ’৯০-এর দশকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে অফিস সহায়ক (পিয়ন) পদে চাকরিতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি এনবিআর প্রধান কার্যালয়ে ছিলেন। এরপর খুলনা, কুষ্টিয়া হয়ে বদলি হন নিজ জেলা সাতক্ষীরায়। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় তিনি কর্মরত ছিলেন সাতক্ষীরা শহরের উপকর কমিশনারের (সার্কেল-১৩) কার্যালয়ে । সেখানে একজন অতিরিক্ত উপকমিশনারের সঙ্গে সখ্য গড়ে অবৈধ পথে বিপুল অর্থ আয় করেন।
সাতক্ষীরার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র পাটকেল ঘাটার পল্লী বিদ্যুৎ রোড সংলগ্ন এলাকায় নজরকাড়া বহুতল শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছেন মাহমুদুল। ‘বাঁধন শপিং কমপ্লেক্স’ নামের এই ভবনে রয়েছে তার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ১২ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত অত্যাধুনিক শপিংমলটি ২০২১ সালে উদ্বোধন করা হয়। জমি ও মালামালসহ এ খাতে তার বিনিয়োগ অন্তত ৩০ কোটি টাকা।
পাটকেলঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ৪৭ দাগের ৯ শতাংশ জমিতে তৈরি করেছেন আলিশান চার তলা বাড়ি। বাড়ির পাশ ঘিরে তৈরি করা হয়েছে পাকা পুকুর। ১৭ শতাংশ জায়গায় ওই পাকা পুকুরকে এলাকার লোকজন সুইমিংপুল হিসাবে জানেন। জায়গা কিনে এই বাড়ি করতে তার অন্তত ২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
স্ত্রী নাছিমা বেগমের নামে পাটকেলঘাটা বাজারের সবচেয়ে দামি রাজেন্দ্রপুর মৌজার ১৪৯ দাগে ১৭ শতাংশ, ১৫০ দাগে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৪৭ দাগে ৯ শতাংশ ও পাটকেলঘাটা চৌরাস্তা মোড়ে ৮১ দাগে ১ শতাংশ জমি কিনেছেন।
এছাড়া, কন্যা ঊর্মির নামে পাটকেল ঘাটার পাঁচ রাস্তা মোড় এলাকায় গড়ে তুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ঊর্মি এন্টারপ্রাইজ’। রয়েছে মালামাল পরিবহণের বেশ কয়েকটি ট্রাক ও ইটভাটা। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে তিনি চোরাকারবারে জড়িত বলে এলাকায় রিউমার রয়েছে।
অথচ তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের নওয়াপাড়া গ্রামে এক সময় মাহমুদুলদের পৈতৃক সম্পত্তি বলতে ভিটাবাড়ি ছাড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সেখানে তার ২০ বিঘা জমির মাছের ঘের, বিভিন্ন ধরনের মালামাল রাখার একটা গোডাউন ও ৮ বিঘা কৃষি জমির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় সিদ্দিক মল্লিকের কাছ থেকে একযোগে ৪ বিঘা জমি নিজের নামে কিনেছেন তিনি। মাহমুদুলের পরিবারের গাড়ির মডেল পালটাতে দেখে এলাকাবাসী বিস্ময়ে হতবাক। বিভিন্ন ব্যাংক ও পোস্ট অফিসে মাহমুদুলের নামে-বেনামে সঞ্চয়পত্র, এফডিআরসহ বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ জমা আছে বলে জানা গেছে।
মাহমুদুল ও তার পরিবারের সদস্যরা বিলাসী জীবনযাপন করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেত্রী মোস্তারি সুলতানা পুতুলের ছেলের সঙ্গে মেয়ে ঊর্মিকে বিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করেছেন মাহমুদুল।উক্ত নেত্রী নিজেকে শেখ হেলালের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এলাকায় ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। মাহমুদও নেত্রীর ক্ষমতার ওপর ভর করে চলতেন। তার প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একাধিকবার দুদকের স্থানীয় কার্যালয়ে তার অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ জমা পড়েছে।
দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখি করায় স্থানীয় সাংবাদিকদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। তার দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে সব ডকুমেন্টসহ একাধিকবার দুদকে অভিযোগ জমা দেয়া হয়েছিল সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে । কিন্তু রহস্যজনক কারণে দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ হিসাবে তিনি এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত হলেও যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তারা নীরব।
সূত্রমতে,বাঁধন শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণের সময় সরকারি খাস জমিতে বাসবাসকারী একটি অসহায় পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। সড়ক ও জনপদের জায়গায় স্থানীয় আবুল হাশেম ও তার স্ত্রী সন্তানরা ৩ যুগেরও অধিক ধরে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করত। তাদেরকে টাকার জোরে স্থানীয় প্রশাসন আর রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে দিনের আলোয় তছনছ করে ভেঙে দেয়া হয় তাদের কুটির। রাতারাতি নির্মাণ শুরু হয় বহুতল ভবন।
অষ্টম শ্রেণী পাশ মাহমুদুল এলাকার রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করতে চান। তিনি অনেক নেতাকর্মীদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক অসৎ কাজ হাছিল করে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। তিনি তার মেয়ের শ্বাশুড়ি মোস্তারি সুলতানা পুতুলকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে রাখতে ও উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বানাতে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।এদিকে সরকার পতনের পর মোস্তারি সুলতানা পুতুল যখন পলাতক তখন সুবিধাবাদি মাহমুদ বিএনপি’র নেতাদের পিছনে টাকা ব্যয় করা শুরু করেছেন। বোল পাল্টিয়ে নব্য বিএনপি সাজার চেষ্টা করছেন।
অতি চালাক মাহমুদুল প্রথম থেকে অবৈধ ভাবে অর্জিত অর্থ সুকৌশলে গোপন রাখার চেষ্টা করে। বিনিয়োগ করেন আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের ব্যবসায়ী কারবারে ও জমিজমা কেনার পিছনে । জানা যায়, নিজের নামের বাইরে পরিবারের অন্যান্য সদস্য, নিকট আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে লুকিয়ে রেখেছে তার অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ। সময় সুযোগ বুঝে সেই সব সম্পদের প্রকাশ ঘটান। আর তার এই কাজে সহযোগিতা করেন তার মেয়ের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এবং তাদের নামেও সম্পদ লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। মাহমুদুল ২ কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় কন্যা সন্তান উর্মিকে ৮/৯ বছর পূর্বে ঢাকঢোল পিটিয়ে কোটি টাকার উপঢৌকন দিয়ে মোস্তারি সুলতানা পুতুল ও মাসুদ বিশ্বাসের পুত্র শুভ বিশ্বাসের সাথে বিয়ে দেয়। এই দম্পতির ফেসবুকে বিদেশ ভ্রমণের অনেক ছবিও দেখা যায় ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অফিস সহায়ক পদের চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে মাহমুদুল অবৈধ ভাবে টাকা উপার্জন শুরু করেন। আয়কর ফাইল খোলার নামে কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে । তার বড় গুণ হলো সুন্দর ভাবে কথা বলে বা কৌশলে বা লোভ দেখিয়ে অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের মন জয় করে তাদের দিয়ে ব্যবসায়িদের খুজে বের করতেন। ব্যবসায়ীরা ছিল তার প্রধান শিকার। টাকার বিনিময়ে রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তার ব্যবস্থা করা ছিল তার কাজ। কোন ফাইলে কীভাবে কাদের ম্যানেজ করে টাকা আয় করতে হয়-সব কিছুই তার সুন্দরভাবে জানা ছিল।
এক সময় তিনি অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও ব্যবসায়ীদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন এবং তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা নিতেন। যে কারণে চাকরি ছেড়ে দিলেও তার কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে। অনেকে জানান, তিনি এক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের চোরাচালানের সাথেও জড়িয়ে পড়েন এবং এক সময় নিজেই চোরাকারবারীদের গডফাদার বনে যান। পাটকেলঘাটা বাজারে তার কাপড়ের দোকান-উর্মী এন্টারপ্রাইজ- মূলত ব্যবসার আড়ালে ভারতীয় কাপড়ের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল।
স্থানীয়দের দাবি দুদুক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা অনুসন্ধান করলে আরো নতুন চাঞ্চল্যকর তথ্য ও আরো সম্পদের সন্ধান পাওয়া যাবে।
মাহমুদুল হাসানের হোয়াটস্অ্যাপে দুদকে প্রদত্ত আবেদনের বিষয়ে তার বক্তব্য চেয়ে বার্তা দিয়ে কোন রেসপন্স পাওয়া যায়নি।