সাইদুর রহমান আপন, শেরপুর প্রতিনিধি
শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বেড়েছে বিভিন্ন নদীর পানি। লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এসব পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসনসহ সেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিজিবি। এছাড়া গতকাল শনিবার (৫ অক্টোবর) সকাল থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধারকাজে যুক্ত হয়েছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই ভাইসহ এ পর্যন্ত মারা গেছে ৭ জন।
শনিবার রাত থেকে নতুন করে শেরপুর সদর এবং নকলা উপজেলার আরও ৭টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় শেরপুরের মহারশি, সোমেশ্বরী, চেল্লাখালি, ভোগাই ও মৃগী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শেরপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত শেরপুরের ৫টি উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আর পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। ঝিনাইগাতী এবং নালিতাবাড়ী উপজেলার সব সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৩৫ বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি স্থানীয়রা।
শেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রনব কুমার কর্মকারের দেয়া তথ্য মতে, শুধু ঝিনাইগাতী এবং নালিতাবাড়ী উপজেলায় ২ হাজার ৫৭টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিক হিসাবে ১১ কোটি টাকার বেশি। আর কৃষি অফিসের তথ্য মতে, জেলার অন্তত ৩০ হাজার হেক্টর আমন আবাদ এবং এক হাজার হেক্টর সবজির আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অন্তত ৭০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে, শনিবার সকাল থেকেই নালিতাবাড়ী উপজেলায় উদ্ধার এবং ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছেন সেনাবাহিনী। ৬টি স্পিড বোর্ডের মাধ্যমে ৬০ জন সেনাসদস্য উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শনিবার দিনভর স্পিডবোট, নৌকা, ভেলা, টিউব ইত্যাদি নিয়ে চলে বন্যায় আটকেপড়াদের উদ্ধার অভিযান। এছাড়াও শুকনা খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে বানভাসিদের মাঝে। এসব কাজে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অংশ নিয়েছে উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।
ঝিনাইগাতী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল জানান, পানিবন্দি মানুষদের সঠিকভাবে উদ্ধার করতে আমরা সফল হয়েছি। অনেককে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি এবং শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উপজেলার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুম রানা জানান, নালিতাবাড়ীতে আশ্রয়কেন্দ্র ১২৩টি। এর মধ্যে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি ইউনিয়নে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, জেলার বেশ কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। দুর্গতদের উদ্ধারে ও শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। একই সঙ্গে নতুন নতুন এলাকায় প্লাবিত হওয়ার খবর পাচ্ছি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সকাল থেকে পাহাড়ি ঢলে শেরপুর চারটি নদীতে পানি বাড়তে থাকায় এই বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে অনেকের বাড়ি-ঘর পানি তলিয়ে গেছে। ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ফলে ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মহারশীর বাঁধ ভেঙে ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়নের ঝিনাইগাতী, রামেরকুড়া, খৈলকুড়া, বনকালি, চতল ও আহম্মদ নগর, ধানশাইল ইউনিয়নের ধানশাইল, বাগেরভিটা, কান্দুলী, বিলাসপুর ও মাদারপুর এবং কাংশা ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর চরণতলা, আয়নাপুর, কাংশাসহ প্রায় দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, শেরপুর নাকুগাঁও স্থলবন্দর স্থবির হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে জেলার অধিকাংশ সড়ক। বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য গ্রামীণ পাকা ও কাঁচা সড়ক। পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন ও উঠতি আমনের খেত। বিভিন্ন স্থানে বানের পানিতে ধসে ও ভেসে গেছে কাঁচা ঘর-বাড়ি। পানিতে ভাসছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র। এসব এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও তা অপর্যাপ্ত।
তবে শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাকিবুজ্জামান খান বলেন, আগামীকাল সোমবারের ভেতর কমবে সব নদীর পানি, উন্নতি হবে বন্যা পরিস্থিতির।