ঢাকা   ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
দৈনিক বিজনেস ফাইল ই-পেপার (বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪) আদানির সঙ্গে চুক্তি পুনর্মূল্যায়নে কমিটি গঠনের নির্দেশ সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ৮ দিনের রিমান্ডে টাঙ্গাইলে বাস-পিকআপ সংঘর্ষ, নিহত ৪ আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ তুললেন ভারতীয় সাংবাদিক, জবাবে যা বলল যুক্তরাষ্ট্র প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাসে সড়ক ছাড়লেন সাদপন্থীরা আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে: অর্থ উপদেষ্টা চুনারুঘাটে ফাঁকা গুলি ছুড়ে জনতার হাতে পিস্তলসহ আটক নীলফামারী-৩ আসনের সাবেক এমপি মেজর রানা হাসিনা রেজিমের ‘ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট’ এখনো বহাল: পর্দার আড়ালে বাণিজ্য সচিব! দৈনিক বিজনেস ফাইল ই-পেপার (মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪)

ভার্চুয়াল ক্লিকে টাকা আয়, কতটা সত্য!

নির্মল বার্তা
  • প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ১৫, ২০২০
  • 122 শেয়ার

‘আপনি কি ঘরে বসে টাকা আয় করতে চান? তাহলে এখনই এই গ্রুপে যোগ দিন। এই গ্রুপে যোগ দিলে প্রতিদিন ২০০/৩০০ টাকা আয় করতে পারবেন। আর দেরি নয়, এখনই সময় অল্প পুঁজির মাধ্যমে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার। আমাদের কোম্পানিতে সীমিত সময়ের জন্য অফার চলছে। অফার গ্রহণ করে নিজের বেকারত্ব দূর করুন!’— এরকম পোস্ট হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু যখনই কেউ ওদের এসব অফারে পা দেয়, তখনই থেকে শুরু হয় কোম্পানির নাটকীয় কাহিনী।

প্রথমে ওই কোম্পানিগুলো আগ্রহী ব্যক্তিকে কিছু এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে জয়েন করায়। এরপর সেখান থেকে নির্দেশনা দিতে থাকে কী কী করতে হবে, আর কী কী করা যাবে না। এভাবে প্রথম কয়েকমাস গ্রুপে একটিভ দেখা যায় তাদের। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায় এজেন্ট ও কোম্পানি দুটোই উধাও। এ বিষয়ে কিছু সংখ্যক ভার্চুয়াল কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তারা অনলাইনে আয় করতে গিয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে জরিমানা গুনেছেন। তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

মাসুদ রানা (২৩)। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। টিউশনির পাশাপাশি আরও কিছু করার জন্য ফেসবুকে বিভিন্ন রকমের কাজ খুঁজতে থাকেন। এক সময় ফেসবুকে Uptownadz.Online নামের একটি কোম্পানির অফার দেখেন। মাত্র আট হাজার টাকা ইনভেস্ট করলে আনলিমিটেড ইনকাম করা যাবে। কাজের ধরণ হিসেবে দেখানো হয়, প্রতিদিন একটা সময়ে পাঁচটি করে ‘এড’ ক্লিক করলে তার অ্যাকাউন্টে ডলার/টাকা জমা হবে। সেখান থেকে বিকেশ/রকেটের মাধ্যমে টাকায় রূপান্তর করা যায়। এছাড়াও রেফার বোনাস তো আছেই। এমন অফার দেখে অনলাইনে পরিচিত একজনের পরামর্শে আট হাজার টাকা দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই কোম্পানি তালবাহানা শুরু করে। ভার্চুয়াল কোম্পানি আছে, কিন্তু ক্লিক করলে আর টাকা দেয় না।

মাসুদ জানান, ভার্চুয়াল কোম্পানিগুলো আসলে কারা তৈরি করে এটা কেউও বলতে পারে না। নির্দিষ্ট পরিমাণে লাভ করতে পারলে তারা গায়েব হয়ে যায়। আবার কিছুদিন পরে নতুন নামে একই কাজ নিয়ে আসে। মানুষকে সর্বশান্ত করে আবার চলে যায়। এতে অনেকেই লোভে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান।

আরেক ভুক্তভোগী মীর আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এক বন্ধুর কথা মতো আমি EssayTaxt.Online নামের একটা কোম্পানিতে ২০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করি। সে আমাকে গ্যারান্টি দেয় যে, দুই মাস কোম্পানি থাকবে। এমনকি বন্ধু জানায় যে, সে ডিলারশিপ নিয়েছে। তার কথা বিশ্বাস করে ২০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করি। কিন্তু ১৫ দিন যেতে না যেতেই কোম্পানির সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধু এখন টাকা ফেরত দিতে না পেরে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ক্লিকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা উঠে এলেও এখনও ১৫ হাজার টাকা লসে আছি। কাকে ধরলে টাকা ফেরত পাব কিছুই জানি না।’

সহজে বেশি আয়ের আশায় বিডিলেন্সার নামের একটি ভার্চুয়াল কোম্পানির ডিলারশিপ নিয়েছিলেন হাসান মাহমুদ। এখন বলতে গেলে সে সর্বশান্ত। তিনি বলেন, ‘এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি ভার্চুয়ালি ক্লিকের মধ্য দিয়ে খুব সহজেই টাকা ইনকাম করা যায়। এতে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক লাভবান হওয়া যায়। এসব কথা শুনে কোনোকিছু যাচাই-বাছাই না করেই আমি ডিলারশিপ নিই। এরপর সেখানে এক লাখ টাকা ইনভেস্ট করি। এছাড়া আমার আওতায় ২০০ জনকে দিয়ে অ্যাকাউন্ট ওপেন করাই।’

হাসান মাহমুদ বলতে থাকেন, ‘প্রথমে দিকে ভালোই চলছিল সব। কিন্তু দুই মাস পরে হঠাৎ করে কোম্পানির সার্ভার অফ হয়ে যায়। এর পর থেকে শুরু নাটকীয় কাহিনী। কোম্পানি কখনও পেমেন্ট অফ করে দেয়, আবার কখনও সার্ভার। এভাবেই কিছুদিন চলতে থাকে। এক সময় অন্যরা আমাকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন বাধ্য হয়ে জায়গা-জমি বিক্রি করে অন্যদের টাকা পরিশোধ করি। এই বিষয়টি নিয়ে কার কাছে যাব, কে এর সমাধান দিতে পারে- ভেবে কোনো কুল-কিনারা পাইনি। এমনকি কোম্পানির মালিক দেশি না বিদেশি তাও জানি না। এছাড়া কোম্পানির সঙ্গে কারা কারা জড়িত এখনও আমার অজানা।

এ বিষয়ে কয়েকজন ফ্রিল্যান্সার জানান, এখন পর্যন্ত অনলাইনে এমন কোনো কাজ আসেনি যে, ক্লিক করলেই টাকা ইনকাম হবে। এটি সম্পূর্ণ প্রতারণার চক্রের কারসাজি। প্রতারক চক্র সরল-সোজা মানুষদের ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। যেহেতু বিষয়টি ভার্চুয়াল তাই তাদের ধরা কঠিন।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ‘ফ্রি-ল্যান্সিংয়ের কোনো ধাপেই ক্লিক এভাবে টাকা পাওয়া যায় না। টাকা পাওয়া যদি এত সহজ হতো তাহলে তো সবাই বড়লোক হয়ে যেত। এক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শুধু আইসিটি নয়, সব ব্যবসাতেই প্রতারক চক্র থাকে। তারা মানুষকে মিসগাইড করে। এক্ষেত্রে মানুষজনকে আরও সচেতন হওয়া দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরও প্রচারণা চালানো জরুরি।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, ‘যারা এই কাজটি করছে তারা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করছে। এক্ষেত্রে যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হতে চায় তাদের সতর্ক হতে হবে। আমরা বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। ভবিষ্যতে মুঠোফোনে এসএমএস দিয়ে বা আইসটি মন্ত্রণালেয়র ফেসবুক বা ওয়েবসাইট থেকে সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া উইং) জাকির হোসেন খান বলেন, ‘আইসিটি খাততে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন বিষয় প্রতিহত করতে আমরা প্রতিনিয়তই কাজ করছি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সাইট বা লিংক বন্ধ করছি। কিন্তু অনেক সময় অনেক সাইট আমাদের নজরে আসে না। যদি কোনো সাইট বা ফেসবুকের কোনো লিংক ক্ষতিকর হয়, আমাদের নজরে আসা মাত্রই আমরা তা বন্ধ করে দেবো।’

মন্তব্য জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমাদের কাছে যদি কোনো অভিযোগ আসে আমরা তাহলে ব্যবস্থা নিই। যে সাইটগুলো প্রতরণামূলক বলে মনে হচ্ছে আমরা সেগুলো স্বেচ্ছায় বন্ধ করে দিচ্ছি। তবে ক্লিক করে টাকা পাওয়া যায় এবং প্রতারণা হচ্ছে- এমন বিষয় নিয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। আর কেউ যদি ইচ্ছে করে প্রতারণার ফাঁদে পা দেয় তাহলে তাকে ঠেকাবে কে! তারপরও আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করব।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জনগণকে এসএমএস দিয়ে সচেতন করার কাজটি সরাসরি এক্ষেত্রে আমাদের নয়। যারা আউটসোর্সিং নিয়ে কাজ করে তাদের মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে বা জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালেই আমরা এসএমএস পাঠাতে পারব।’

২০১১ সালের দিকে ডলান্সার (Dolancer) নামের একটা ভার্চুয়াল কোম্পানি এসে মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে বাংলাদেশ একের পর এক এসব ঘটনা ঘটেই চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, কোম্পানি আসছে-যাচ্ছে, জনসাধারণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে; তবুও প্রশাসনের এ বিষয়ে কোনো নজর নেই।

এ বিষয়ে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) মিডিয়া শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জিসানুল ইসলাম জিসান বলেন, ‘সিআইডির সাইবার প্রতারণা প্রতিরোধ টিম বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে অনেক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। অনলাইনে ক্লিক করলে টাকা পাওয়া যায়- এরকম বিষয়ে এখনও কোনো অভিযোগ পায়নি সিআইডি। কেউ অভিযোগ করলে এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ সম্পর্কিত আরো সংবাদ
© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২০