সড়কে বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে অনেকদিন ধরে। একেকটি সড়ক যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদ। ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরার চিন্তাও যেন অচিন্তনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রকম সময়ে মানুষের ভরসার জায়গা ছিল রেলপথ। আর যাই হোক এখানে সড়কের মতো হুট করে প্রাণ হারানোর ভয় ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু সেই ভরসার জায়গাটিও বোধ হয় ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা সম্ভবত সেটাই জানান দিচ্ছে। বর্তমানে রেলপথে দুর্ঘটনার প্রবণতা এতটাই বেড়েছে যে এতে অনেকেরই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।
প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে যত মানুষ প্রাণ হারায়, বিশ্বের খুব কম দেশেই এমনটা হয়। এ ছাড়া আমাদের হাতে কোনো তৃতীয় অপশনও নেই। সড়ক-মহাসড়ক-নৌপথ সর্বত্রই ফাঁদ পেতে আছে মৃত্যু।
এই ধারায় সাম্প্রতিক সময়ে রেলেও যেন দুর্ঘটনার হিড়িক পড়েছে। দেশের কয়েকটি দৈনিকের প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে এদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র। ২০১৯ সালের শুধু আগস্ট মাসের ১ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে দেশে পনেরোটি ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনে সাতটি এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনে আটটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। আর বিগত সাড়ে পাঁচ বছরে ১ হাজার ৮টিরও বেশি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৩০ জন। বেসরকারি হিসাবে গত ৮ বছরে রেলের ছোট-বড় দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০। এতে প্রাণ হারায় প্রায় আড়াইশ যাত্রী।
২০১৯ সালের ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে প্রাণ হারায় পাঁচজন। আহত হয় শতাধিক যাত্রী। এ ছাড়া ছোটখাটো লাইনচ্যুতির ঘটনা তো আছেই। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও ৭টি বগি লাইনচ্যুত হলে তাতে আগুন ধরে আহত হয় ২৫ জন। এর দুদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ত‚র্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষে ১৬ জন প্রাণ হারায়। আহত হয় শতাধিক যাত্রী।
বাহন হিসেবে আমাদের দেশে রেলের যাত্রা শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীতে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার জগতী এবং চুয়াডাঙ্গার দর্শনার মধ্যে প্রায় সোয়া ৫৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইনের মাধ্যমে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরও কিছুদিন পরে আরও প্রায় ১৫ কিলোমিটার মিটারগেজ লাইন স্থাপন করা হয়। বেঙ্গল আসাম রেলওয়ে কোম্পানি ছিল এর তত্তাবধায়ক। ১৮৯৫ সালের ১ জুলাই ব্রিটিশ রেলওয়ে কোম্পানি বড় মাত্রায় রেলরুটের সম্প্রসারণ ঘটায়। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা এবং লাকসাম ও চাঁদপুর রেলরুটের আওতায় আসে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর রেল ব্যবস্থাপনারও আমূল পরিবর্তন ঘটে। ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’ নাম পরিবর্তন করে পুনঃনির্ধারণ করা হয় ‘পূর্ব-পাকিস্তান (তদানীন্তন) ইস্টার্ন রেলওয়ে’। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের রেলপথের দৈর্ঘ্য ২,৮৫৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে রেলের পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের ৬৬০ কিলোমিটার ব্রডগেজ (ডাবল) ট্র্যাকের, বাকিটুকু পূর্বাঞ্চলীয় জোনের মিটার গেজ (সিঙ্গেল) লাইনের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশ রেলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংযোজন হচ্ছেÑ ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতুর উদ্বোধন। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত এ সেতু রেলের পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটায়। পূর্ব ও পশ্চিমে সরাসরি স্থাপিত হয় রেল যোগাযোগ।
লক্ষণীয়, রেলপথ স্থাপনের পর প্রায় ২০০ বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা। এর মধ্যে মানবসভ্যতা দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় গড়িয়ে গেছে অনেক জল। কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকরা রেলের যে অবকাঠামো রেখে গিয়েছিল তা থেকে খুব একটা উন্নত অবস্থানে আমরা রেলকে নিয়ে যেতে পারিনি। এর নেপথ্যে প্রযুক্তিজ্ঞান স্বল্পতা যেমন দায়ী তেমনই দায়ী কায়েমি স্বার্থবাদী বেসরকারি পরিবহন সেক্টরের কিছু চক্র যারা সবসময় রেলে উন্নত অবকাঠামো সম্প্রসারণে অন্তরালে থেকে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ রেলের রেলরুটে খুঁজে দেখলে হয়তো এখনও ব্রিটিশদের স্থাপিত স্লিপার কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবে। দেখা যাবে কোথাও হয়তো পাথর সরে গেছে কিংবা পাথরই নেই। আবার কোথাও রেলপাতে যেমন ক্ষয় ধরেছে তেমনই ক্ষয় ধরেছে এর কাঠের সি্লপারেও। সোজা কথা রেলের চাকায় মরচে পড়েছেÑ এ যেন আর চলছে না। কিন্তু তা তো হতে দেওয়া যাবে না। রেল না চললে এ দেশও চলবে না। কারণ এখনও এদেশে রেলই সাধারণের বাহনভরসা। যে করেই হোক রেলকে সচল করতে হবে, রেলের চাকার মরচে ঘঁষেমেজে তাকে চকচকে করে তুলতে হবে।
হাল আমলে রেলে অনেক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও নিরাপদ জনবাহন হিসেবে কেন রেল তার ভাবমূর্তি হারাতে বসেছে তা অনেক দুর্ভাবনার জন্ম দেয়।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডবি্লউবিবি) ট্রাস্টের এক গবেষণা অনুযায়ী, মুখোমুখি সংঘর্ষ, ট্রেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, লেভেল ক্রসিং, সিগন্যালিং ত্রæটি ও লাইনচ্যুতিসহ বিভিন্ন কারণে রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়াও রেলওয়ের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, লোকবল ঘাটতি, নিয়মিত তদারকি ও মেরামতের অভাব, রেলপথে মানসম্মত পর্যাপ্ত পাথরের স্বল্পতা ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে ডবি্রউবিবি।
বিভিন্ন দেশে রেল দুর্ঘটনা রোধে নানা প্রযুক্তির প্রয়োগ দেখলেও আমাদের দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া আমরা এখনও দেখিনি। আমাদের পাশর্ব্বর্তী দেশ ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে কোনো রেললাইনে দুটি ট্রেন মুখোমুখি চলে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। এত দুর্ঘটনার পরও আমাদের দেশে কেন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে না তা আমার বোধগম্য নয়।
ঘনঘন দুর্ঘটনায় এক সময়ের নিরাপদ বাহন এখন অনিরাপদ। ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে আমরা কি আশু কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছি? কোনো পরিবর্তন কি আমরা আনতে পেরেছি। কোনো দুর্ঘটনা হলে সঙ্গে সঙ্গে দুয়েকটি তদন্ত কমিটি ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ কি আমরা গ্রহণ করতে পেরেছি? তাই বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে রেলকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর সময় হয়েছেÑ এটা বলা যায়।
রেলে ভ্রমণ বর্তমানে একটি আতঙ্কের নাম হলেও বাহন হিসেবে একে ত্যাগ করারও কোনো উপায় নেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় সাধারণ মানুষ নিরাপদ ভ্রমণের জন্য এখনও রেলওয়ের ওপরই বহুলাংশে নির্ভরশীল। আমাদের সবার দাবি নিরাপদ রেলপথ, নিরাপদ ট্রেন ভ্রমণ, নিরাপদ জীবন। আমরা পরিবার নিয়ে একসঙ্গে ট্রেনে ভ্রমণ করতে চাই। ট্রেনকে পরিণত করতে চাই ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপদ অনুষঙ্গে।
লেখক: সাংবাদিক, নির্মল বর্মন