সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশ। একের পর এক ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। নেই কোনো সমাধান। সমাধান চিন্তার আগেই ঝড়ের বেগে উড়ে আসে নতুন কোনো ক্লাইমেক্স! ২০১৮ সালে নুসরাত হত্যা ছিল সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এরপর বরগুনায় রিফাত ফরাজী হত্যা। আবরার হত্যা। চলে আসে সম্রাট কাহিনি। এই কা- শেষ না হতেই পাপিয়ার সাম্রাজ্য আবিষ্কার।
২০২০ সাল শুরু হল নানান ঘটনার বীজ বুনে। বিশ্বজুড়ে নেমে এলো প্রাকৃতিক সহিংসতা! মহামারী। এ মহামারীতে জন্ম নিল রিজেন্ট সাহেদ, সাবরিনার দুর্ধর্ষ সব প্রতারণার খবর। থলের বিড়াল বের হলো একে একে। ক্যাপ্টেন সিনহার হত্যা দেশ আরেকবার বাকরুদ্ধ হয়ে কাতর হলো। সমালোচনার ঝড়ে আকাশ বাতাস ছেয়ে গেল। একটু বাতাস শ্লথ হলে সিলেট এমসি কলেজে ঘটে নয় পান্ডার সহযোগে এক নববধূ ধর্ষণের ঘটনা। মিডিয়া সরব থাকলেও প্রশাসন থাকে নির্বিকার। খুঁজে পায় না পান্ডাদের। অবশেষে একে একে ধরা পড়ে ধর্ষণ কাজে নিয়োজিত ‘যোদ্ধারা’।
তাদের বিচার শুরু হবে কি হবে না এমনটাও উচ্চারিত হওয়ার আগেই বগুড়ার আলোচিত মিন্নি-রিফাত-নয়ন বন্ডের ত্রিভুজ প্রেমের বলি মামলার রায়ে মোড় ঘুরে যায়। মিন্নিকে নিয়ে দেশে তুমুল সমালোচনার ঝড়ের পূর্বাভাস যেমন শুরুতে ছিল এখন তা আবার সোনার বাটিতে নিয়ে চুষে চুষে খাচ্ছে বাংলার জমিনের ক্ষুরধার বিশেষজ্ঞরা।
এদেশে এমনিতে নারী জাতের সামান্য ত্রুটি পেলে কিংবা দোষ না থাকলেও গবেষণায় তা বেরিয়ে আনতে বেশ পোদ্দার কান্ডারিরা। রায় না দিলেও পাবলিক মুখে কুলুপ দেওয়া বেশ কঠিন। আবার রায় মিন্নির বিপক্ষে দেওয়াতেও চলছে কানাঘুষা। তার রূপ, চোখের চাহনির ভাষাও কেউ কেউ খুঁজে চলেছেন। যে নারীর চোখের ছলনায় হারিয়ে যায় হাজার পুরুষ! রিফাত ও নয়ন বন্ডও হারিয়েছিল নিজেদের সে চোখে।
একসঙ্গে দুই স্বামীতে ব্যাকুল ছিলেন মিন্নি। পরিণতি তাদের চরম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হলো। মিন্নি চলে গেলেন কারাগারে। আজব সাগরে দেশ ভাসছে। কূল নেই, কিনারা নেই। নৌকা কূলে কিছুতেই ভিড়ছে না। দেশের দায়িত্ববানরা পাবলিক সেন্টিমেন্ট বোঝে না। গণতন্ত্র বলে ভোটের সময়, তাদের স্বার্থে যথাসময়ে। কার্যত দেখা মেলে না গণতন্ত্রের। মুখে তালা পাবলিকের! বললেই খবর আছে!
মিউ মিউ তোষামোদ আর ভেজা বিড়ালের মতো ছায়া কায়েম হওয়ার পর ধর্ষণ মহামারী আকারে বিস্তার করেছে। কোনো বয়স মানছে না ধর্ষক। ওত পাতা শেয়াল, হায়েনার মতো ঘাপটি মেরে থাকে ধর্ষক সাহেবরা। নারী-শিশু কোথাও নিরাপদ না। ঘরও না। আপনজনের কাছেও নিরাপদ না। রেহাই নাই তাদের। পুরুষের ঘাড়ে শয়তান উঠবে তখনি লাফিয়ে পড়বে নারীর ওপর। করোনায় ধর্ষণ করতে ভয় পাবে ভেবেছিলাম। তাও হয়নি। বরং বেড়েছে। সুযোগ পেয়েছে অন্য সময়ের তুলনায় আরও। একটা ধর্ষণ। সপ্তাহখানেক হৈ চৈ। এরপর আরেকটি। কিছুদিন চুপ। আবার শুরু।
মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ধর্ষক মহাশয়রা। যে কেউ যখন তখন ধর্ষক চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে। কেন? বিচার না হওয়ায় এর তীব্রতা ছড়াচ্ছে সাধারণের মানুষের অভিযোগ। কিছুদিন জেল, আদালত, রিমান্ড। এরপর থানার বারান্দা হতেও ধর্ষক পার পেয়ে যাচ্ছে। কিছু ঘটনায় ধর্ষিতার পরিবার হুমকির শিকার হয়। সম্মান, আবাস, অর্থ হারিয়ে পালিয়ে বেড়ায় জীবনহানির আশঙ্কায় ধর্ষিতা।
ক্ষমতাসীন দলের কেউ হলেই প্রতিক্রিয়া আসে তারা দলের কেউ না। মানুষ বিরক্ত এমন বক্তব্যে। দলীয় হবে না দলের বাইরে কেউ হবে এটা তো ধর্ষকের পরিচয় নয়। আশ্চর্য হলেও এভাবেই ধর্ষকের তালিকা বাড়ছে। আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ কম! ফলাফল, অপরাধী অপরাধ করতে সাহস পায়। বিশ্বের ইসলামিক দেশগুলোতে নারীর দিকে সামান্য চাহনি দিলেই পুলিশ অভিযোগ করলে ধরে নিয়ে যাওয়ার রেকর্ড আছে। সৌদিতে ধর্ষকের মাথা কাটার নির্দেশ আছে। কোথাও অন্ডকোষ কাটার বিধান আছে। দেশীয় আইনে দুই বছরের কারাদণ্ড বহাল! দুঃখজনক অধ্যায়! কী করে যাবে নোংরা কাজটি। আমেরিকা ধর্ষণের জন্য এক নম্বর কাতারে অবস্থান করলেও বাংলাদেশ তাকে ছাড়িয়ে যাবে, যদি না সরকার কঠোর না হয়।
সরকার যতক্ষণ কথা বলবে না ততক্ষণ তা কার্যকর হবে না। এমন ট্র্রাডিশন হররোজ দেখছি। আমেরিকার সংস্কৃতি আর বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিস্তর ব্যবধান। তবুও এই ভায়োল্যান্স খবরটা পরিসংখ্যানে আসে। সেখানে প্রতি ৬ জন নারীর ভিতর ১ জন ধর্ষিত হয়। আমাদের ইসলামিক দেশে এ হার বেড়ে শিশু হতে শুরু করে সব বয়সী নারী ধর্ষিত হচ্ছে। কখনো ধর্ষণের পর জীবনহানি ঘটানোর কলঙ্কিত ইতিহাসও আছে।
২০১৯ সালে শিশু সায়মাকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করে তারই ধর্ষক। এর ধারাবাহিকতায় আরও ঘটনা ঘটেছে। এরপরে নাম না জানা সব হত্যা-ধর্ষণের পর ঘটে যাচ্ছে। অনর্গল নারীর বীভৎস, উলঙ্গ লাশের খবর আসে। দক্ষিণ আফ্রিকা ধর্ষণের মাত্রায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, এজন্য রেপ ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড বলা হয়। বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব কী নামে অবহিত করবে শেষপর্যন্ত! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষকের শাস্তি হয় না বললেই চলে। যাও হয় তাও প্রহসন! শিকারি বারবার ধর্ষণ হয় বিচিত্র রকমভেদে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ছয়টি জেলায় ৪,৩৭২টি ধর্ষণ মামলার মাত্র ৫ জন ধর্ষকের শাস্তি হয়।
এত বড় সংখ্যায় বোঝা যায় ধর্ষণ মামলাটি কত হালকা! থানায় মামলা গ্রহণে থাকে দুর্বলতা। নিরীহ ধর্ষিতারা তা টেরও পায় না। ২৯০ দন্ড-বিধির ধারায় অবৈধ যৌনকাজে ধরা পড়াদের বেলায় এটি কার্যকর। কিন্তু প্রকৃত ধর্ষিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২৯০ ধারায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। বুঝতেই পারে না তারা। শুরুতেই হালকা ও ভুল অভিযোগে ধর্ষিতা ফেঁসে যায়। পুলিশ ধর্ষক থেকে সুকৌশলে টাকা ভোগ করে। তাকেও কঠিন মামলার ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা আদায় করে। এক সময় মামলা থেকে খারিজ করে দেওয়া হয়; এভাবে।
মসজিদের ইমাম, স্কুলের শিক্ষক, গির্জার ফাদার, মন্দিরের পুরোহিত কেউই বাদ যাচ্ছে না ধর্ষণের মজা উপভোগ করতে। বীভৎসতার কলঙ্ক লেগে গেছে। অপ্রতিরোধ্য মহামারীটা ঘরে ঘরে ছেয়ে যাওয়ার আগে সরকারকে সজাগ হতে হবে। না হলে নারী শিশুর জন্য যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা ছাড়া পথ খোলা থাকবে না। নারীপ্রধান দেশে মহামারী লাগাতার চলছে, এজন্য সাধারণ শ্রেণির মনে শঙ্কা- কী করে সম্ভব! এমন বিচারহীনতা নারীরা আগে ভাবত সরকারপ্রধান নারী হলে নিরাপদ থাকবে। সুযোগ তারা পাবে। সুযোগ পাচ্ছে, আরেক দিকে কেড়ে নিচ্ছে নারীসত্তা! উচ্চবিত্ত হতেও নারী ভোগের শিকার; নিম্নবিত্তেও সেরকমই। কেবল ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন!
লেখক: সাহিদা সাম্য লীনা, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক