বিজনেস ফাইল প্রতিবেদক
গণ-অভ্যুত্থান পূর্ণ বিজয়ের দিকে যায়নি। পূর্ণ বিজয় হলে গণসার্বভৌমত্ব কায়েম হতো। শেখ হাসিনা যেদিন পালিয়ে গেছেন, সেদিনই আন্দোলনের নেতৃত্বের হাতে গাঠনিক বা রাষ্ট্রশক্তি এসে পড়েছিল। এমতাবস্থায় কোনো আইন আর তাদের অধীনে নিতে পারে না।
কিন্তু এর পরও পুরনো সংবিধান ও আইনের অধীনেই রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে অর্জিত গণ-অভ্যুত্থান এখনো সংহত হয়নি। আগামী দিনের প্রধান লড়াই হবে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত একক বত্তৃদ্ধতা অনুষ্ঠানে কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার এসব কথা বলেন।
মহান বিজয় দিবস ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে গতকাল সোমবার একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বত্তৃদ্ধতার এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘দেশে আমরা অভ্যুত্থান এনেছি, কিন্তু এখনো একে সংহত করতে পারিনি।
সংবিধানের দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবাহিত বাংলাদেশে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ধারাবাহিকভাবে বিনষ্ট করা হয়েছে। সে আশঙ্কা এখন আরো তীব্র হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গণমানুষের গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের জন্যই একাত্তরে মানুষ রক্ত দিয়েছে, চব্বিশেও মানুষ রক্ত দিতে দ্বিধা করেনি। এই সাধারণ মানুষের জীবনে বিপ্লবের সুফল বয়ে আনতে প্রথাগত পথে হাঁটলে হবে না, বরং আমাদের চিন্তা ও তৎপরতায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বিজয় দিবস তখন তার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে যখন এ দেশের মানুষ বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ লাভ করবে।
একক বত্তৃদ্ধতায় ফরহাদ মজহার বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান পূর্ণ বিজয়ের দিকে যায়নি। এটিকে পূর্ণ করা মানে গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করা। এর আগের যে ফ্যাসিস্ট সংবিধান বিদ্যমান রয়েছে, এ ছাড়াও আমাদের আধা-আবছায়া যে স্তরগুলো রয়েছে, তা থেকে আমরা বের হতে পারিনি। একটি ঘোষণা দেওয়া দরকার ছিল। গণ-অভ্যুত্থান মূলত সব আইন ভেঙে হাজির হয়, সব পুরনো আইন ভেঙে দিয়ে নতুন আইন গঠন করার প্রতিশ্রুতিতে।’
তিনি বলেন, ‘সমস্যা হলো, আমরা কথায় কথায় সংবিধান শব্দটি ব্যবহার করি। পৃথিবীতে যখন সংবিধান ছিল না তখনো সমাজ ছিল। পৃথিবীতে যখন সংবিধান থাকবে না তখনো কিন্তু সমাজ থাকবে, রাষ্ট্রও থাকবে। উদাহরণ কী? যেমন ইংল্যান্ড। তাদের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। জনগণের যে অভিপ্রায় বিভিন্নভাবে ব্যক্ত হয়, হাজির থাকে, বর্তমান হয়, তাকেই ব্যাপ্ত অর্থে রাষ্ট্র বলে। রাষ্ট্রের এই ধারণটা আমরা অনেকেই জানি না। জানি না বলেই রাষ্ট্র বলতে আমরা কেউ আইন বুঝি, বল প্রয়োগের হাতিয়ার বুঝি, আমি পুরনো মার্ক্সবাদী ধারা থেকে বড় হয়েছি, ফলে রাষ্ট্র মাত্রই বল প্রয়োগের হাতিয়ার—এই ছিল সে সময়ে ধারণা। এই বল প্রয়োগের হাতিয়ার যে প্রতিষ্ঠান, এটা দখল করতে আবারও বল প্রয়োগই লাগবে। আপনি জানবেন যে উনসত্তর থেকে যে বামপন্থী রাজনৈতিক ধারাটি গড়ে উঠেছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে এই অনুমানগুলোর কারণে। লেনিন কিন্তু ব্যর্থ হননি। তাঁর যে রাজনৈতিক কৌশল সেটা এই অনুমান ছিল না। তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন মতাদর্শিক সংগ্রামে।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমরা গণশক্তি তৈরি করেছি। গণশক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অতি সহজে আমরা পরবর্তী স্তরে ঢুকতে পারতাম, যেটাকে বলা হয় গাঠনিক শক্তি। যেদিন শেখ হাসিনা পালিয়েছেন, সেদিনই আন্দোলনের নেতৃত্বের কাছে গাঠনিক বা রাষ্ট্রের শক্তি এসে গেছে। তারা তখন আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। কোনো আইন আর তাদের অধীনে নিতে পারবে না। কিন্তু ঘটনাটা অন্য রকম হয়ে গেল।’
একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘সমাজে দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি পক্ষ মনে করেছিল, এবারের বিজয় দিবস সেভাবে উদযাপন করা হবে না। আরেকটি পক্ষের মধ্যে একাত্তরের যুদ্ধ ও বিজয় দিবসের মাহাত্ম্য হ্রাস করে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। এই দুই পক্ষকে মোটেও গুরুত্ব না দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ আজ (গতকাল) বিজয় দিবস উদযাপন করেছে। এটাই আসল বাংলাদেশ। রাজনৈতিক মতাদর্শপীড়িত প্রচারণার বাইরে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে, যে সমাজ কাঙ্ক্ষিত মুক্তিকামী রাষ্ট্র তৈরি করবে। এই আকাঙ্ক্ষার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ সম্প্রতি প্রাণ দিয়েছেন এবং আরো মানুষ প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন।’
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের বৃহত্তর জনমানুষের বিজয়ের জন্য আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিভাজনে আমরা অনেক ঘুরপাক খেয়েছি। তবে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সংগ্রামই প্রকৃত সংগ্রাম।’