Agaminews
Dr. Neem Hakim

কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ!


দৈনিক বিজনেস ফাইল প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২, ২০২৫, ৭:৫৯ অপরাহ্ন /
কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ!

সার আমদানির নামে এলসিতে অর্থ পাচার, সরকারি অর্থ লোটপাট

বিজনেস ফাইল প্রতিবেদক
কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে সার আমদানির নামে সরকারি অর্থ লোটপাট, নিম্নমানের ও ভেজাল সার আমদানি, লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি)’র মাধ্যমে অর্থ পাচার, সরকারি অর্থ লোটপাট, দুর্নীতিসহ গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) চুক্তির মাধ্যমে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকেই সার আমদানি করার কথা। কিন্তু এই নীতিমালা লঙ্ঘন করে বিদেশি বেসরকারি ট্রেডিং কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি থেকে বড় ধরনের অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে সার আমদানির অনুমতি দেওয়া, অন্তর্বতীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলতে এবং ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করতে সুকৌশলে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি বিশেষ সিন্ডিকেট ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ খোরশেদ আলমের যোগসাজশে দরপত্র প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে এবং সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ মূল্যে কাজ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মোঃ মোবারক হোসেন নামে একজন ব্যবসায়ী কর্তৃক দাখিলকৃত এক অভিযোগ পত্রে এই সব তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগ পত্রে জানায়ায়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে জি টু জি’র মাধ্যমে সেই দেশের সরকারীভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে সার আমদানী করে থাকে। জিটুজির চুক্তি অনুযায়ী সেই দেশের বেসরকারীভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন ট্রেডিং কোম্পানীর নিকট থেকে কোন ভাবেই সার আমদানী করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু চায়না থেকে সার আমদানীর জন্য বিগত ২০২৪ সালে চায়নার সাথে বিএডিসি’র স্বাক্ষরিত চুক্তিতে দু’টি উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ থাকলেও ২০২৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে চায়নার সকল উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ রয়েছে। এতে নিম্ন মান সম্পন্ন ডিএপি সার আমদানি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দু’টি উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানের স্থলে একাধিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সার আমদানী করতে হলে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং গ্রহণ না করে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বিএডিসি কর্তৃক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছে। চীনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে মোট ৭টি লটে শিপমেন্টের জন্য নির্ধারিত সিডিউল ছিল ২৫ এপ্রিল থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ডিএপি সারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কম থাকলেও উল্লেখিত সময়ে কোন শিপমেন্ট করা হয়নি। পরবর্তীতে গত ২৫জুলাই আন্তর্জাতিক বাজারে ডিএপি সারের দাম যখন সর্বোচ্চ তখন থেকে শিপমেন্ট শুরু করে। এদিকে অক্টোবর মাসে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে যখন ডিএপি সারের দাম কমতে থাকে তখন একসাথে ৪টি লটের ডিএপি সারের দাম নির্ধারণ করা হয় এবং নির্ধারিত লে-ক্যানের বাইরে ইচ্ছামত জাহাজ লোড পোর্টে পাঠানো হয়।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছর সার আমদানিতে অব্যবস্থাপনা, বিলম্ব, জিটুজির নামে কমিশন বাণিজ্যের কারনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। নিজেদের কমিশন বানিজ্যের জন্য বিগত ফ্যাসিস সরকারের দোসর কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খোরশেদ আলমের নির্দেশে গত ২৪ মে চায়নার ইউনাইটেড সির্টিস ট্রেডিং কোং. লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নিকট ১২.০০.০০০০,০৩৫.৪০.০২০.২৫-১০৮ নং স্মারকে টিএসপি, ডিএপি এবং অন্যান্য সার ক্রয়ের জন্যে প্রস্তাব পাঠায় বিগত ফ্যাসিস সরকারের আরেক দোসর কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। চায়নার ইউনাইটেড সির্টিস ট্রেডিং কোং. লিমিটেড নামক এই ট্রেডিং কোম্পানীটি মূলত স্পিয়ার পার্স, কাঠ ও প্লাস্টিক আইটেম প্রস্তুত ও সরবরাহ করে থাকে। সার আমদানির সঙ্গে ইউনাইটেড সির্টিস ট্রেডিং কোং. লিমিটেড কোনো সম্পর্কই নেই। এছাড়া জিটুজি চুক্তি হচ্ছে সরকার টু সরকারের চুক্তি। জিটুজি চুক্তির নামে এই ধরণের ট্রেডিং কোম্পানির কাছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার আমদানী প্রস্তাব প্রেরণ করা মানে উচ্চ মূল্যে কমিশন পাওয়া ।
অভিযোগ পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, চায়নায় তৃতীয় লটের জন্য নির্ধারিত লে-ক্যান ছিল ৯ থেকে ১৫ অক্টোবর। বিএডিসির সাথে চায়নার সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী লে-ক্যানের ২১ দিন আগেই অথ্যাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও বিএডিসি ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করে পেলে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে প্রতি মে. টন ডিএপি সারের দাম ৭৬৮.৭৫ মার্কিন ডলার। বিএডিসি চুক্তিতে নির্ধারিত ফর্মুলা অনুযায়ী ডিএপি সারের মূল্য নির্ধারণ না করে ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে ৭৭২.৫০ মার্কিন ডলার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এই মূল্য জাহাজ ভাড়া ব্যতিত। এছাড়া প্রতি মেট্টিকটন সার লোকার খরচ যোগ হবে আরো ১শ ডলার। এতে ৪৪ হাজার মে. টন ডিএপি সার আমদানিতে প্রতি মে. টন ১০৫ মার্কিন ডলার করে সরকারের প্রায় সাড়ে ৫৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। চুক্তিতে উল্লেখিত নির্ধারিত ফর্মুলার ছাড়া সারের দাম নির্ধারণের সুযোগ না থাকলেও এক্ষেত্রে বিএডিসি ও কৃষি মন্ত্রণালয় দুর্নীতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন গ্র্র্রহণ করে সরকারি অর্থ মানি লন্ডারিং করেছে। উক্ত লটের জাহাজ এখন পর্যন্ত লোড পোর্টে পৌছেনি। জাহাজ লোড পোর্টে পৌছানোর ২১ দিন আগেই ২ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে তৃতীয় লটের মূল্য হয়ার কথা ৭৫৬.২৫ মার্কিন ডলার। এই মূল্য জাহাজ ভাড়া ব্যতিত। এছাড়া প্রতি মেট্টিকটন সার লোকাল খরচ যোগ হবে আরো ১শ ডলার। এছাড়া তৃতীয় লটেও প্রতি মে. টন ১১৬.২৫ মার্কিন ডলার করে ৪৪ হাজার মে. টনে ৬৩ কোটি টাকা এলসির মাধ্যমে পাচার করে বিদেশে গ্রহণ করছে বিএডিসি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, চীন থেকে আমদানীকৃত সারের চতুর্থ লটের নির্ধারিত লে-ক্যান ছিল ১৫-২১ অক্টোবর। বিএডিসি’র সাথে চীনের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী লে-ক্যানের ২১ দিন আগে অর্থ্যাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে প্রতি মে. টন ডিএপি সারের দাম আসে ৭৬৮.৭৫ মার্কিন ডলার। এই মূল্যও জাহাজ ভাড়া ব্যতিত। এছাড়া প্রতি মেট্টিকটন সার লোকাল খরচ যোগ হবে আরো ১শ ডলার। পরবর্তীতে উক্ত লটের জাহাজ ২৯ অক্টোবর লোড পোর্টে পৌছায়। জাহাজ লোড পোর্টে পৌছানোর ২১ দিন আগের ২ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে চতুর্থ লটের দর হওয়ার কথা ৭৫৬.২৫ মার্কিন ডলার। এখানেও এই মূল্য জাহাজ ভাড়া ব্যতিত। এছাড়া প্রতি মেট্টিকটন সার লোকার খরচ যোগ হবে আরো ১শ ডলার। চতুর্থ লটেও প্রতি মে. টন ১১৪.৫০ মার্কিন ডলার করে ৪৪ হাজার মে. টনে কয়েক কোটি টাকা বিএডিসির কর্মকর্তারা পাচার করেছে।
দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগ পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, চীন থেকে আমদানীকৃত সারের যষ্ঠ লটের নির্ধারিত লে-ক্যান হওয়ার কথা ছিল ২২-২৮ অক্টোবর। বিএডিসি’র সাথে চীনের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী লে-ক্যানের ২১ দিন আগেই ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আর্গুস ও ফার্টিকনের ভিত্তিতে প্রতি মে. টন ডিএপি সারের দাম ৭৬৮.৭৫ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয় এবং সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন করা হয়। সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর বিএডিসি কর্তৃক উক্ত লটের লে-ক্যান ২৫ থেকে ৩০ অক্টোবর পুনঃনির্ধারণ করা হয়। তবে পুনঃনির্ধারিত লে-ক্যান ২৫ থেকে ৩০ অক্টোবর অনুযায়ী সারের দাম প্রতি মে. টন ৭৫৬.২৫ মার্কিন ডলার হলেও বিএডিসি কর্তৃক উক্ত দরের পরিবর্তে সারের দাম ৭৬৮.৭৫ মার্কিন ডলার বহাল রাখা হয়। এই মূল্য জাহাজ ভাড়া ব্যতিত। এছাড়া প্রতি মেট্টিকটন সার লোকাল খরচ যোগ হবে আরো ১শ ডলার। পরবর্তীতে উক্ত লটের জাহাজ ২৯ অক্টোবর তারিখে লোড পোর্টে পৌছায়। যষ্ঠ লটেও প্রতি মে. টন ৭৬৮.৭৫ মার্কিন ডলার। এই মূল্যটিও জাহাজ ভাড়া ব্যতিত। এছাড়া প্রতি মেট্টিকটন সার লোকাল খরচ যোগ হবে আরো ১শ ডলার। এতে করেও ৪৪ হাজার মে. টনে ৭০ কোটি টাকা বিএডিসির কর্মকর্তারা এলসির মাধ্যমে পাচার করেছে।
রাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় চীন থেকে উল্লেখিত তিনটি লটের ডিএপি সার আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদিত/নির্ধারিত লে-ক্যানের বাইরে পরবর্তীতে ভিন্ন লে-ক্যান নির্ধারণ করা হলেও এক্ষেত্রে বিএডিসি কর্তৃক কৃষি মন্ত্রণালয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সংশোধিত অনুমোদন কিংবা সারের দাম পুন:নির্ধারণ করা হয়নি। পুন:নিধারিত লে-ক্যান অনুযায়ী সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদন গ্রহণ না করে বিএডিসি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মিলে প্রায় শত কোটি টাকা ডলারের মাধ্যমে পাচার করেছে।
এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খোরশেদ আলম ছিলেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী ও বিসিবির সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের একনিষ্ঠ সহযোগী ও ভৈরবের সাবেক উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা বলেও দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ খোরশেদ আলমকে মোবাইলে কল করা হলে তিনি ধরেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার সাড়া পাওয়া যায়নি।